বিশ্ব শিক্ষক দিবস : আয়রে পাখি লেজঝোলা
ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
১। আমার শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল শোলাবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চক শ্লেট আর বই হাতে নিয়ে বিশ্বরোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে গিয়ে হাজির হতাম। কক্ষ ভর্তি ছেলেমেয়ে। মাঝেমধ্যে বসার জায়গা পেতাম না। বসলেও অপরপ্রান্ত থেকে ঢেলে নিচে ফেলে দিতো। আমরা এই রকম ঠেলাঠেলি আর চিল্লাপাল্লা করে স্কুলঘর মাথায় তুলে রাখতাম। এরই মধ্যেে স্যার বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে হাজির হতেন । সাথে সাথে আমরা সবাই চুপচাপ হয়ে যেতাম। ক্লাসে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসতে। স্যার ছড়া পড়াতে শুরু করতেন- ‘আয়রে পাখি লেজঝোলা / খোকনকে নিয়ে কর খেলা।’ আমরা সব খোকনরা সমস্বরে গানের মতো উচ্চস্বরে বলতাম- আয়রে পাখি লেজঝোলা…। ‘
২। বিশ্বরোড ধরে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাওয়া ঝুঁকি ছিল। বাড়ির দক্ষিণদিকে দুতিন মিনিট হাঁটলেই এবতেদায়ী মাদরাসা। নিরাপত্তার জন্যই বাবা বাড়ির পাশের মাদ্রাসায় যেতে বললেন। আমিও গেলাম। টিনের ঘর, টিনের বেড়া তাও আবার ভাঙা। সময়ে সময়ে ছাগল ঢুকে হাগুহিশু করে চলে যেতো । শিক্ষকদের বেতন নেই। কেউ কেউ সকাল নয়টা পর্যন্ত মাঠেঘাটে কাজ করে স্কুলে আসতেন। আমাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় গাওয়াইতেন। আমরা সবাই সমস্বরে গেয়ে উঠতাম- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ঐ বয়সে দেশকে ভালোবাসতাম কিনা জানি না। তবে স্যারদের ভালোবাসা আমরা বুঝতে পারতাম। কালো বোর্ডে চক ডাস্টার দিয়ে অংক করাতেন । আমাদের আমির স্যার, লতিফ স্যার, মহসিন স্যার, আউয়াল স্যার, সোবহান স্যার, কারী হুজুর এইসব শিক্ষক অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো তারা বিনা বেতনে চাকরি করতেন আর বেতন পাওয়া যায় এমন চাকরি খুঁজতেন। একসময় স্যারা ভালো ভালো চাকরি নিয়ে চলে যায়। আমরাও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ঐ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেই। চলে আসি পুষ্পপাড়া আলিয়া মাদ্রাসায়।
৩। পুষ্পপাড়া আলিয়া মাদ্রাসার নামডাক সবাই জানে। আমাদের ইলিয়াস স্যার, সাদেক স্যার, শরিফ স্যার, ছালাম স্যার, নাসির স্যার, মাহবুব স্যার, পুলক স্যার, ইউনুস স্যার, নজির আহমদ স্যার, আব্দুল হাই স্যারসহ সব শিক্ষকের মুখমন্ডল এখনো আমাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। নাসির স্যার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হয়ে কুষ্টিয়ার চলে গেলেন। আমাদেরও এসএসসি পরীক্ষা চলে এসো। মাদরাসার সামনে দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার উপহার লেখা এডওয়ার্ড কলেজের বিশাল একটা গাড়ি যাতায়াত করতো। মনে মনে ভাবতাম, ঐ গাড়িতে যদি চড়তে পারতাম! যদি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হতে পারতাম।
৪। বাস্তবিকই এসএসসি পাশ করে এডওয়ার্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলাম। ঐ সময়ে আমরা ছিলাম এডওয়ার্ড কলেজের ইন্টারমেডিয়েটের লাস্ট ব্যাচ। নাটক কিংবা সিনেমার নায়ক নয়, ঐ সময়ে আমাদের শিক্ষকরাই ছিলেন আমাদের হিরো, আমাদের নায়ক। আমাদের শিমুল মাহমুদ স্যার, জাহাঙ্গীর স্যার, সোলায়মান স্যার, আব্দুল আউয়াল স্যার, মোস্তফা স্যার, আমিনুল স্যার, লুৎফর স্যার, বজলুর রহমান স্যার, আজাদ স্যার, হুমায়ুন স্যার, খালিকুজ্জামান স্যার, শফিক স্যার, ছালাম স্যারসহ এইসব শিক্ষক ছিলেন আমাদের আইডল। আমরা মনে মনে ঐ সব শিক্ষকের মতো সফলকাম মানুষ হতে চাইতাম।
৫। অর্থনীতির সামাদ স্যার খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। স্টেজে দাঁড়িয়ে ব্লাক বোর্ডে লিখতেন। সাধারণ জ্ঞানের জন্য বড়ালের বই পড়তে বলতেন। ব্লাকবোর্ডে লিখতে গিয়ে স্যারের পুরো হাত সাদা হয়ে যেতো। ক্লাস শেষে দেখি, বিভাগে পানি দিয়ে স্যার হাত ধৌত করছেন। ঐ সময়ের স্যারের একটি কথা আছে। এডওয়ার্ড কলেজ প্রসঙ্গে স্যার বলছিলেন- নামে তালগাছ কিন্তু ঘটি ডোবে না। ঐ সময়ে কথাটির অর্থ না বুঝলেও এখন কিছুটা বুঝি। সামাদ স্যারের ঐ কথাটির মধ্যে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার বঞ্চনার চিত্র লুকিয়ে আছে। যা হোক, শিমুল মাহমুদ স্যার, ছালামসহ অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। আমরাও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় গিয়ে উঠি।
৬। আমি পড়েছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের হায়াৎ মামুদ স্যার, মুজ্জাম্মেল স্যার, দানিউল হক স্যার, শামসুল হক স্যার, খালেদ হোসাইন স্যার, আশরাফ স্যার, অনিরুদ্ধ কাহালি স্যার, রাবেয়া ম্যাডাম, সৌদা ম্যাডাম, ফাতেমা ম্যাডাম, ইউএস শামসুন্নাহার ম্যাডাম এইসব গুণিজনকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। শিক্ষকরা আমাদের গড়ে তোলার জন্য কতইনা চেষ্টা করতেন। কাহালি স্যার উপন্যাস পড়াতেন। আলালের ঘরের দুলাল পড়া দিতেন। বেশকিছুদিন পর কার কার পড়া শেষ হয়েছে খোঁজখবর নিতেন। যাদের পড়া হয়নি তাদের আবারও সময় দিতেন। কিন্তু আমরা কয়েকজন এমনই বাদর ছিলাম যে কোনভাবেই পড়তাম না। শেষে একদিন কাহালি স্যার ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। এমনকি আমরা না পড়েও ফাইনাল পরীক্ষা দিতাম। আমাদের অনেকেরই স্লোগান ছিল- পড়লেও সেকেন্ড ক্লাস না পড়লেও সেকেন্ড ক্লাস। তাই আমরা পড়তাম না। এখন বুঝি, আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের পড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করতেন।
৭। পড়াশোনা শেষে নিজেও শিক্ষক হলাম। পিএইচডি ভর্তির জন্য স্যারদের সাথে যোগাযোগ কৱলাম। রিসার্চ প্রপোজাল সাবমিট করলাম। কিন্তু অনার্স মাস্টার্সে প্রথমশ্রেণি না থাকায় জাহাঙ্গীরনগরে পিএইচডিতে ভর্তি হতে পারলাম না। ইতোমধ্যে আমার তিনটি গবেষণামূলক আর্টিকেল প্রকাশ হয়ে গেছে। আমি এটি দিয়ে সরাসরি পিএইচডিতে ভর্তি হতে চাই। গেলাম অনিরুদ্ধ কাহালি স্যারের কাছে। স্যার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. রহমান হাবিব স্যারের কাছে ফোন করে দিলেন। আমি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। ড. রহমান হাবিব স্যার হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। আমার পড়াশোনা, লেখালেখির কথা শুনলেন। তারপর আরেকদিন গেলাম। দেখলাম, স্যার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
এইভাবে আমি আমার শিক্ষকদের ভালোবাসা পেয়েছি, আদর স্নেহ পেয়েছি। ঠিক সময়মতো পিএইচডিও শেষ করলাম। আমাকে গড়ে তোলার পেছনে এইসব শিক্ষকদের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমার বহু শিক্ষক এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে শিক্ষকের হাতে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল তিনিও বিদায় নিয়েছেন। হয়তো তার নাম মনে নেই, চেহারাও মনে নেই। কিন্তু স্যারের ঐ কণ্ঠটা এখনো আমার কানে বাজে। আমি এখনো আমার কর্ণকুহরে স্পষ্ট শুনতে পাই- ‘আয়রে পাখি লেজঝোলা / খোকনকে নিয়ে কর খেলা।’ হে স্রষ্টা আমাদের ওস্তাদগণের ওপর তোমার অন্তহীন রহমত বর্ষণ করিও। আর যারা জীবিত আছে তাদের নেক হায়াৎ বাড়িয়ে দিও-বিশ্বশিক্ষক দিবসে এই আমার প্রার্থনা।
ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
বাংলা বিভাগ
পাবনা সরকারি মহিলা কলেজ, পাবনা।