ছাত্র সংসদ কী, এর কাজ কী? ছাত্ররা জানে কি?
মোশাররফ হোসেন মুসা
১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর ১৫- এর মাধ্যমে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর ও ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ পদে ছাত্র শিবির সমর্থিত প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল জয়ী হবে তার আগাম হিসাব কষা শুরু করেছেন। অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনেরই অংশ। কিন্তু কেউই ছাত্র সংসদ কি, এর কাজ কি এবং ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক কি না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না।
এখানে সংক্ষেপে ডাকসু’র গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন, ডাকসুর পূর্ণ অর্থ হলো – ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী বৈঠক তথা সিনেট সভায় অংশগ্রহণ এবং তাদের দাবি উথ্বাপন করতে পারেন । তাদের কর্মকাণ্ড হবে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। ডাকসুতে দুটি বিভাগ ; একটি ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ ও আরেকটি ‘হল সংসদ’। কেন্দ্রীয় সংসদ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা করবে এবং ‘হল সংসদ’ হল কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করবে। ডাকসু’র কেন্দ্রীয় পরিষদে ২৮টি পদ রয়েছে , একইভাবে প্রতিটি হল সংসদে ১৩ টি করে পদ রয়েছে। কেন্দ্রীয় পরিষদের সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সহ-সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক , কমনরুম-রিডিং রুম-ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক, ক্রীড়া সম্পাদক পদ, ছাত্রপরিবহন সম্পাদক, সমাজসেবা সম্পাদক, ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদ রয়েছে।
পদের নামগুলোই প্রমাণ করে তাদের কাজ কি? তথা ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল পদই রয়েছে ডাকসুতে। ডাকসু একান্তই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের; এর বড় প্রমাণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেখানে ভোট দিতে যান না। কিন্তু বাস্তবতা হলো – ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাধীন নয়। এগুলো জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা সংগঠন। তাদের প্রার্থী কে হবেন, সেটাও মুল দলের নেতারা নির্ধারণ করে দেন। অথচ যারা এদেশে গণতন্ত্র আমদানি করেছেন তাদের দেশে ছাত্র রাজনীতি ভিন্ন। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্র প্রতিনিধিরা বিতর্ক অনুষ্ঠান, পরিবেশ সংরক্ষণ, মানবাধিকার, শিক্ষার উন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন । ইংল্যান্ডে সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশের ছাত্র রাজনীতিও একই রকম। ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক থাকায় বিদেশি বহু ছাত্র পড়তে গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। তার মানে এই নয়, সেসব দেশের ছাত্ররা রাজনীতি মুক্ত। তারা জাতীয় স্বার্থে কিংবা মানবাধিকার লংঘনে সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপ না দেখলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
কখনো কখনো সহিংস হয়ে ওঠে। তারা কখনো কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করে না। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু বিদেশি ছাত্র পড়তে আসেন, কিন্তু তারা যখন দেখতে পান ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাধীন নয়, তখনোই তারা ছাত্র সংগঠন থেকে দশ হাত দুরে থাকেন। এদেশে একটি খোড়া যুক্তি আছে, তাহলো বিশ্ববিদ্যালয় হলো নেতৃত্ব তৈরির কারখানা। তাহলে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন এসে যায়- স্থানীয় সরকার, প্রেস ক্লাব, ব্যবসায়ী সমিতি, শিক্ষক সমিতি, পরিবহন সমিতি সহ বিভিন্ন নামে সংগঠনগুলো কি নেতৃত্ব উপহার দিতে অক্ষম? ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তাঁরা একসময় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন। বলা হয়, সেখানকার রাজনীতিকরা স্থানীয় সরকারে প্রশিক্ষণ নেন কেন্দ্রীয় সরকারে যাওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় হলো উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জায়গা। বহু কষ্ট করে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান।
অভিভাবকদেরও তাদের সন্তানদের প্রতি বহু আশা থাকে। কোনো অভিভাবক চান না, তার সন্তান অসুস্থ রাজনীতিতে জড়িয়ে জীবন নষ্ট করুক; কিংবা অসুস্থ ছাত্র রাজনীতির শিকার হয়ে তার সন্তানের জীবনহানি ঘটুক। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়। সেজন্য এগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। দেখা গেছে- যারা ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাদের অধিকাংশ পরবর্তী জীবনে জাতীয় রাজনীতি বেছে নেন, কম সংখ্যক প্রতিনিধি কর্মজীবনে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুক্তের সময় একটি শ্লোগান দেয়ালে দেয়ালে দেখা যেতো- কলম ছেড়ে অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিভিন্ন বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে। সেসব বিভাগ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছেন, তথা দেশ পরিচালনার জন্য অভিভাবক শ্রেণী রয়েছেন। অভিভাবকদের ব্যর্থতার কারণে কিংবা তাদের স্বার্থের কারণে ছাত্রদের বার বার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সেকারণে প্রশ্ন করা উচিত- ছাত্ররা যদি জাতীয় রাজনীতির মুল শক্তি হয়, তাহলে রাজনীতিতে বুড়া নেতাদের থাকার দরকার কি?
লেখক: মোশাররফ হোসেন মুসা, গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।