আনন্দধামের মহান পুরুষ
(ষাট দশকের বিশিষ্ট লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বেদুর প্রতি)
বারডেমের হিম ঘরে শুয়ে থেকে কেটে গেল তিনদিন
এই নিদ্রা চেয়েছিলেন বুঝি? গভীর নিমগ্ন যাপন।
শীতের কুয়াশা মাখা ভোর,
আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছাতিমের সুবাস আজ আপনার সঙ্গী।
সকালভোরেই যে ফোনটা আসতো আমার কাছে-
তা আর আসবে না কখনো।
ওপ্রান্ত থেকে কেউ আর বলবে না- ‘আমিরুল’ তুমি আসবে?
কত কথা, কত আলাপ, কত তর্ক – রাজনীতি,
শেষ মেশ আপনি হার মানতেন, নিরব চুপচাপ সময় যখন-
তখন আমরা মিশে যেতাম রবীন্দ্র- নজরুলে।
তখন আমরা- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি,
তখন- ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’।
আপনি ত রবীন্দ্রঅন্ত প্রাণ।
সামনে বাইশে শ্রাবণ। আপনি বললেন, তুমি আমার এই বইটা তাড়াতাড়ি করে দাও।
রবীন্দ্রনাথ ৮২ বছর বেঁচেছেন, আমারও ঐ তারিখে মৃত্যু।
না বেদু ভাই, আপনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেলেন-
হৃৎস্পন্দনের ঘণ্টা যখন থেমে গেল- তখন আপনি ৮৫।
বেদু ভাই, মূহুরমু ফোন বাজে আমার কানে,
হঠাৎ বাজনা থেমে গিয়ে একটা শব্দ ভেসে আসে-
‘আমিরুল, তুমি আসছ? আমিরুল, তুমি আসবে’?
বুলবুল পাখিটা আগেই চলে গিয়েছিল, তারপর গেল পিউকাহা,
এরপর আপনি, হাড় কাঁপানো শীতের সকালে
সেই যে ঘুম দিলেন, আর কোনো সাড়া নেই।
বেদু ভাই, আপনার প্রিয় পান্ডুলিপি
‘আমার রবীন্দ্র ভাবনা’ আপনার দিকে চেয়ে আছে।
ওর একটা হিল্লে করা দরকার। আরো কটা-
‘গৌতম বুদ্ধ’, Hundred poems of Love, ‘বাঙালি হওয়ার ভিত্তিকথা’।
চান মিয়া আর কখনো আপনাকে নিয়ে যাবে না পাঠক সমাবেশে। ও পাঠ আজ চুকে গেল।
রবীন্দ্র একাডেমি, উত্তরা সাহিত্য পরিষদ কিম্বা সাম্প্রতিক –এর
আর কোনো আলোচনা হবে না আপনার সাথে। যা হয়েছিল আজ তা অতীত।
দূর আকাশের বুকের মাঝে জ্বলে এক ধ্রুব তারা।
আপনার মনে পড়ে, গোলাপ গ্রামের সেই গানের আসরের কথা?
সারাদিন- সারাবেলা, কী মজাই না হয়েছিল সেদিন- আপনিই আয়োজন করেছিলেন।
এই দেখো, তখন থেকে আমি একলাই বলে যাচ্ছি,
আপনি কিছু বলুন, আর কত ঘুমাবেন? এই শীতে
বারডেমের হিমঘরে, একা, সংগোপনে, নিস্তব্ধতার চাদরে।
এই ঘুম চেয়েছিলেন বুঝি?
তাই আর জাগিবার নেই কোনো স্বাদ,
জাগিবার গাঢ় বেদনার, নেই কোনো জাগার আহ্লাদ।
আপনার মোবাইল ফোনে কল দিলে
ও প্রান্ত থেকে বাজতে থাকে
‘আমার পরানে যাহা চাই, তুমি তাই গো..’
সত্যি বলছি বেদু ভাই,
আমার পরানে যাহা চাই, তুমি তাই-
হে আনন্দধামের মহান পুরুষ।
১৫-১-২০২৫
বায়না
পানির গন্ধ শোকে জলজ উদ্ভিদ
আকাশে জেগে থাকে আধখানা চাঁদ
আমিও ছিলেম সাথে ভুলে গিয়ে নিদ
নীশিথ-পূর্ণিমা, আরো কত রাত।
জীবন কেটে যায় খেলারই ছলে
জমিনের উপরে ভেসে আছে নীল
তারই মাঝখানে কত গিনিপিগ
রঙিন ফানুস ওড়ে কত ঝিলমিল।
মৃত্যুকে চেয়ে দেখে কাকডাকা ভোর
সময়টা বেধে রাখা যায় না
তবুও জন্ম দেয় সবুজ পৃথিবী
মনে জমে কতশত বায়না।
অনন্ত সকাল
আকাশ থেকে উড়ে গেল পাখি
হারিয়ে গেল সাথীহারা শোক
রৌদ্র ভেঙে পড়ছে মেঘের বুকে
নয়ন তুলে দ্যাখে অচিন লোক।
বনজ ছায়ায় ক্লান্ত হয়ে পথিক
ক্লান্ত ছাড়ে গাছের নিচে বসে
দৃষ্টি জোড়া দিগন্ত গেছে বেঁকে
আরো কিছু যেতে হবে হেসে।
পথ ফুরালে তুমি মন ফুরালে
শেষ হবে যখন সেই দিগন্ত
সূর্য বেলা যদিও অস্ত যাবে
আবার ভবে সূর্য উঠবে অনন্ত।
৮. ৯. ২০২৩
কৃষ্ণ প্রহর
রাত পেরুলেই অন্ধকার
অন্ধকারের পরেই রাত
সকাল- দুপুর হারিয়ে গেল
জীবন থেকে অকস্মাৎ।
নদী মরু, শূন্য পানি
এগিয়ে যাওয়া স্রোত নেই
দাঁড় বায় না সুজন মাঝি
যা ছিল সব শৈশবেই।
রাত পেরুলেই কৃষ্ণসময়
কৃষ্ণ বাঁশি কার হাতে
জীবনব্যাপি হুতোম প্যাঁচা
ডেকে ওঠে মাঝরাতে।
আর ডেকো না হুতোম প্যাঁচা
কৃষ্ণ প্রহর যাক টুটি
জীবন ভরুক আলোক ভোর
অকল্যাণ যত পাক ছুটি।
৯.৯.২০২৩
লাভ-ক্ষতি
শস্য ফুলের বুকে যত মধু
রৌদ্র আলোয় শুকিয়ে যাওয়ার আগে
ভ্রমরখানা তাকিয়ে থাকে শুধু
সবুজ পাতার আড়াল থেকে জাগে।
কাকতাড়ুয়া চেয়ে অপলক
দাঁড়িয়ে আছে নড়ছে না সটান
দূরে বসে প্রজাপতির শোক
ভেজা ঘাসে হাঁটছে শালিখ ক’খান।
সন্ধ্যা নামে পূব আকাশটি লাল
হলুদ বনে ঘুমায় প্রজাপতি
জাগবে আবার জাগবে কাল সকাল
ভ্রমরার তাতে নেই কোনো ক্ষতি।
আমিরুল বাসার, কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার
সম্পাদক- সাম্প্রতিক