স্বপ্ন দেখা এক যুদ্ধের অনুলিপি
আশরাফ খান
প্রতিদিনের মতো রুটিন মাফিক সাংসারিক কাজ সেরে রাতে ঘুমাতে যায় ইলোরা বেগম। সংসারে মা ছেলের চড়–ই পাখির আহার তৈরী ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই বললেই চলে। মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়ির ভাড়া আর গ্রামের আবাদী জমির ফসল যা পায় তা দিয়ে মোটামুটি গরিবায়ানা হালে চলে যায় তাদের জীবন। রাতে শোবার পর সহজে ঘুম আসে না ইলোরা বেগমের। রাতটাকে পাথরের মতো ভারী মনে হয়। মনে হয় হয়তো কোন একদিন এই পাথরের আঘাতেই মারা যাবে সে। রাতে যারা গন্ডারের মতো নাক ডেকে ঘুমায় তাদের দেখে খুব হিংসা হয় তার। শোবার পর ঘুম না আসলে তার যে কি ভীষণ যন্ত্রণা তা হারে হারে বুঝতে পারে ইলোরা বেগম। তাই রাতে ঘুমানোর জন্য সে একটি কৌশল অবলম্বন করে। বালিশে হেলান দিয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে বই পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর ঘুম ঘুম ভাব হলে কোনদিন টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে আবার কোনদিন টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে যায়। বই পড়ার এই পদ্ধতিটি ঘুমের ঔষুধের মতো কাজ করে বলে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া আজকাল তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হলো না। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ বইটি পড়তে পড়তে বইতে মুখ রেখেই ঘুমিয়ে যায় ইলোরা বেগম। ঘুমের ঘোরে সে এক অদ্ভূদ স্বপ্ন দেখতে পায়।
ইলোরা বেগম স্বপ্নে দেখেন-
“পোষাক কারখানার শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছে। তাদের তিনদফা দাবি-
১.শ্রমিকদের দিয়ে দৈনিক আট ঘন্টার অধিক কাজ করানো যাবে না।
২. দ্রব্যমূল্যর সাথে সামঞ্জস্য রেখে কমপক্ষে ০৬ (ছয়) সদস্যবিশিষ্ট (নিজ + স্ত্রী/স্বামী+ছেলেমেয়ে ০২জন + পিতা+মাতা) একটি পরিবারকোনমতে সারামাস ডাল ভাত খেয়ে জীবন যাপন করতে পারে এরকম মাসিক বেতন নির্ধারণ করতে হবে।
৩. এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ বছরে নূন্যতম ০২ টি উৎসব ভাতা প্রদান করতে হবে।
কারখানার মালিকগণ তিনদফা দাবী বাস্তবায়ন না করলে শ্রমিকরা আর কাপড় তৈয়ার করবেনা। একই দাবি ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হলেও এবারের আন্দোলনে অনেকটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। একই সময়ে একই দাবীতে তৈরী পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের সাথে আন্দোলনে নেমেছে তৃণমূল পর্যায়ের তাঁত শ্রমিকগণ। ফলে এ আন্দোলন কেন্দ্রের পাশাপাশি দেশের সকল জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁত শ্রমিকরাও বলছে তাদের দাবী আদায় না হলে তারা শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি তৈরী করবে না। এমন কথা শুনে অনেকে হাসাহাসি করছে।
ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সুশীল সমাজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একদল ধর্মঘটের বিপক্ষে। অন্যদল শ্রমিকদের পক্ষ নিয়েছে। তবে শ্রমিকদের পক্ষে সংখ্যা খুবই কম। তৈরী পোষাকের পাশাপাশি লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, কাপড় মজুদ চলছে। প্রকাশ্যে। অপ্রকাশ্যে। বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুন, তিনগুন অথবা তারও বেশি দামে। ধর্মঘট চলছে এবং চলছে। সমাধানের লক্ষণ নেই। নতুন কোন কাপড় আসছে না বাজারে। মজুদও প্রায় শেষের দিকে। উচ্চ মূল্যের বিনিময়েও লুঙ্গি পাচ্ছেনা ধনীরা। আর ভুখা-নাঙ্গারা তো হিসেবের বাইরে। মেয়েদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ। “এবার ন্যাংটা এক দেশ দেখবো। হগলেই ন্যাংটা থাকলে চোখে বাঁধবে না।” স্টেশনে দাড়িয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে এসব কথা বলছে টনি পাগল। টনি পাগল এ শহরের একটি চেনা মুখ। তাকে কমবেশি সবাই চেনে। স্টেশনের আশপাশের অঞ্চল তার বিচরণ ক্ষেত্র। সারাদিন এ দোকানে সে দোকানে চেয়ে খায় আর রাত হলে প্লাটফর্মে শুয়ে থাকে। এতোটুকুই তার পরিচয়। তার শিকড়ের খবর কেউ জানে না।
কাপড়ের সংকটে যখন জনজীবন অতিষ্ঠ ঠিক তখন আরো একটি নতুন সংকট দেখা দেয়। সাবান পাওয়া যাচ্ছে না বাজারে। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের দাবীর সাথে একত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে সাবান কারখানার শ্রমিকরাও। চারদিকে এমন গুজব শোনা যাচ্ছে। বাজারে নতুন কাপড় নেই। আবার পুরান কাপড় পরিষ্কার করার উপকরণও ফুরিয়ে যাচ্ছে। হতাশায় ভুগছে নগরবাসী। ধর্মঘট চলছে এবং চলছে। সমাধানে কোন লক্ষণ নেই।
আস্তে আস্তে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে সংকট। ভদ্রপাড়ার লোকগুলো যতটা সম্ভাব ঘরেই অবস্থান করছে। প্রয়োজন অনেক মানুষকে পুরানো জীর্ণ শীর্ণ ময়লাযুক্ত কাপড়ে রাস্তায় নেমে এনেছে। ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে নি¤œ আয়ের মানুষের কাপড়ের মজুদ। যা মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগ। পড়নের উপযোগী কাপড় না থাকায় রাস্তা-ঘাটে, পার্কে-উদ্যানে এবং নদীর ধারে ল্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকে। ন্যাংটা, এখন আর কোন সমস্যা নয়। সবাই মেনে নিয়েছে। বরং কাপড় পড়া মানুষগুলোই জঞ্জাল। দুই একজন কাপড় পড়া মানুষ দেখলেই, ল্যাংটা মানুষগুলো তার দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে এবং এক পর্যায়ে তাকেও ল্যাংটা করে ছেড়ে দেয় রাস্তায়।
পোষাক ও সাবান কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে ঠিক তখন আন্দোলন শুরু করেছে হরিজন সম্প্রদায়। তবে তাদের দাবি ভিন্ন। তাদের সংগ্রাম সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মেথর বলে সমাজে তাদের কোন দাম নেই। চায়ের দোকানদার চা দিতে ইতস্তত বোধ করে। বাজারে দাড়ালে ভদ্র মানুষগুলো তাদেরকে ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দেয়। যেন তাদের শরীর থেকে গুয়ের গন্ধ বের হচ্ছে। অর্জুন পেশায় হরিজন হলেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। পদবিতে মেথর বলে ভালো চাকরি হয়নি। মানুষের গু-মুত পরিষ্কার করাই যেন তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পেশা। বংশ পরম্পরায় বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের এই পেশা থেকে বের হতে পারেনি অর্জুন। উচ্চশিক্ষা তাকে উচ্চ মর্যাদা দিতে পারেনি। অর্জুন দীর্ঘদিন একটি পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, একদিন তারা সমাজে সম্মানিত হবে। অর্জুন মনে মনে ভাবে- আমরা যাদের গু মুত পরিস্কার করি, লোকে তাদের ভদ্রলোক বলে সম্মান করে, পক্ষান্তরে, আমাদের ঘেন্না করে, অস্পৃশ্য মনে করে। এটা কোন জীবন হলো। কুকুর বেড়ালের মতো মূল্যহীন এক জীবন। তাই দীর্ঘদিন অর্জুন সহজাতিদের সংঘটিত করছে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য। এবার তার পরিশ্রম সফল হয়েছে। কলোনির সামনে সমবেত হয়েছে শতাধিক মেথর। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে মিড়িয়া পাড়ার এক ঝাঁক সংবাদ কর্মী। আন্দোলনে সহজাতিদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সংবাদ কর্মীদের উপস্থিতি অর্জুনের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। সমবেত মেথরদের উদ্দেশ্য সে বলে “এই ছোন ছালার ভদদো মানুছগুলো আমাদের ছোট জাত বলে বলে গালি দেয়। গেন্না করে। ধিক্কার দেয়। আছ থেকে আমরা আর ওগোরে গু মুত ছাফ করমু না। ওগোরের গু ওরাই ছাফ করুক।” সমবেত সকলে সমস্বরে বলে ওঠে- হ… হ..। ঠিক….ঠিক….। তাই…তাই….।’’ অর্জুনের চারদিকে তাক করে আছে মিডিয়া পাড়ার কমপক্ষে এক ডজন ক্যামেরা।
কাপড়ের অভাবে রাস্তায় নেমে আসা নিরুপায় ন্যাংটা মানুষগুলো সুইপারদের আন্দোলনের তীব্রতা আন্দাজ করে শৌচাগার রিজার্ভ রেখে রাস্তাঘাটে মলমূত্র ত্যাগ করতে শুরু করেছে। গু মুতের গন্ধে রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে না। শহর অঞ্চলের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ডাস্টবিনে বাড়ছে ময়লার স্তুপ। ডাস্টবিন থেকে ময়লা নেমে এসেছে রাস্তায়। ময়লার ভিতরে মাঝে মধ্যে রক্তভেজা ন্যাকড়া এবং কনডমও উঁকি মারে। মল, মুত্র,রক্ত এবং বীর্যের সংমিশ্রণে এক বিদঘুটে গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। জানালা দরজা বন্ধ করে ঘরে অবস্থান করছে গৃহস্থলির লোকজন।
পোষাক ও শিল্প কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর ঠিক তখন আরো একটি নতুন সংকট দেখা যায়। পরিবহন শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডেকেছে। তাদের ধর্মঘটের কারণ অবশ্য ভিন্ন। কিছুদিন আগে শহরের স্টেশন রোডে ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা শত বছর বয়সী বৃদ্ধ কড়ি গাছটার নিচে ফুটপাতের দোকানগুলোর সামনে সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এতে নগর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না থাকলেও রীতিমতো সেখান থেকে যাত্রী উঠানামা করায় ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় বলে ব্যবসায়ীরা একত্রিত হয়ে অটোরিকশা রাখতে বাধা দিলে উভয়পক্ষের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে অটোরিকশা চালকগণ মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের খবর দিলে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা এসে ব্যবসায়ীদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে ব্যবসায়ীগণ একত্রিত হয়ে তাদের উপর হামলা করে। এতে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের শীর্ষস্থানীয় দুইজন নেতা গুরুতর আহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে শ্রমিকরা প্রথমে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দেন। তারপর বন্ধ হয় বাস-ট্রাকসহ সকল যানবাহন। এমনকি রাস্তায় কোন ভ্যান রিক্সাও নেই। যানবাহনের অভাবে রাস্তাঘাট চৈত্রের দুপুরের মতো খাঁ খাঁ করছে। ভীষণ বিপদে আছে পথচারীগণ। সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে মুমূর্ষ রুগিরা। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের অভাব নেই। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে পৌছানোর কোন যানবাহন নেই। কিছুটা চিন্তায় আছে চিকিৎসকগণ। রুগি না আসায় তারাও ধীরে ধীরে বেকার হতে চলছে। এভাবে চলতে থাকলে রুগি মারা যাবে বিনা চিকিৎসায় আর ডাক্তার মারা যাবে বিনা পয়সায়।
ধীরে ধীরে বাড়ছে আন্দোলনের পরিধি। সংক্রামক ভাইরাসের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চারদিকে হৈচৈ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষগুলো বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে কিছু যৌক্তিক দাবী নিয়ে খুই শিঘ্রই আন্দোলনে শুরু করতে পারে ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ও সুতাকল শ্রমিক। এমতাবস্তায়, নড়ে চড়ে বসেছে বুদ্ধিজীবী মহল। পোশাক শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে মেথরদের আন্দোলন। মেথরদের সাথে একত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে মুচি এবং নাপিত। মেথরদের দাবীর সাথে নাপিতদের আরো একটি নতুন দাবী সংযোজন হয়েছে। তাদের মনের খেদ -‘ এক শ্রেণীর ভদ্রলোক চুল দাড়ি কামানোর পর জামা খুলে আকাশের দিকে হাত তুলে বগল বের করে ধরে এবং বলে বগলের চুল পরিস্কার করে দে। তাদের বগল থেকে ঘামের দুর্গন্ধ বের হয়। কিছু কিছু মানুষের বগলের গন্ধে বমি আসার উপক্রম হয়’। নাপিতদের দাবী তারা আর কারোর বগলের চুল কাটবে না। অনুরুপ মেথরদের দাবীর সাথে মুচিদেরও একটি নতুন দাবী সংযোজন হয়েছে। তাদের মনের খেদ – ‘ভদ্রলোকগুলো পায়েতে জুতা রেখে তাদের মুখের সামনে পা বাড়িয়ে দেয় এবং বলে জুতা পরিস্কার করে দে’। মুচিদের দাবী তারা কারোর পায়ে থাকা জুতা পরিস্কার করবে না। পরিস্কার করতে হলে জুতা খুলে আনতে হবে।
সারাদেশে বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবীদের আন্দোলন চলছে এবং চলছে। আন্দোলন থামার কোন লক্ষণ নেই। মুচি জুতা মেরামত ও তৈরীর কাজ বন্ধ করায় ল্যাংটা মানুষগুলো খালি পায়ে হাটা শুরু করেছে। নাপিত না থাকায় লম্বা লম্বা চুল বড় বড় অগোছালো দাড়ি এবং গোঁফ নিয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসহায় মানুষগুলো। অবস্থাটা ঠিক এমন যে, খালি পায়ে ন্যাংটা মানুষগুলো লম্বা লম্বা চুল, বড় বড় উস্কুখুস্কু দাড়ি-গোফ নিয়ে চলাচল করছে রাস্তাঘাটে। যেন আদিম যুগের পুনরুন্থান ঘটেছে।
মুনাফাখোর মজুদার এবং মধ্যসত্বভোগীদের দূর্নীতি দূর করে নায্য মূল্যের দাবীতে খুব দ্রুত কৃষক এবং জেলেরা আন্দোলনে নামবে। চারদিকে এমন খবর শোনা যাচ্ছে। এ খবর মানুষের মনে নতুন এক ভীতি সঞ্চার করেছে। ল্যাংটা হলেও এতোদিন দু’বেলা দু’মুঠো মাছ ভাত খেয়ে বেঁচে আছে তারা। এবার সেই সম্ভাবনাটুকুও শেষ হতে চলছে। সংকুচিত হয়ে আসছে সময়। জেলে মাছ আর কৃষক চাল, ডাল, সবজির যোগান না দিলে মানুষের না খেয়ে মরা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। বুদ্ধিজীবীদের জরুরী সভা বসেছে। তারা সমস্যা সমাধানের পথ খুজছে।
আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে ঠিক তখন হঠাৎ নিখোঁজ হয় আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক। কেউ বলছে ক্ষমতাশীনরা গোপনে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আবার কেউ বলছে সে নিজে থেকেই আত্মগোপন করেছে।”
এমনি একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে ভোর বেলায় ইলোরা বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
২.
ইলোরা বেগমের একমাত্র সন্তান বিপ্লব। দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ। বিপ্লব তখন ইলোরা বেগমের গর্ভে। একদিন শক্রপক্ষ আক্রমণ করে তাদের গ্রামে। সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বিপ্লবের বাবাসহ প্রায় চল্লিশজন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে খালের পাড়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। তার কয়েকদিন পরেই বিপ্লব ভূমিষ্ঠ হয়। যুদ্ধের সময় জন্মগ্রহণ করে বলে ইলোরা বেগম তার ছেলের নাম রাখেন ‘বিপ্লব’। ছেলে তার সারাদিন কি সব মিটিং মিছিল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ইলোরা বেগম এসবের কিছু বোঝেন না। ওই রকম একটি দুঃস্বপ্ন দেখার পর ঘুম থেকে উঠে ইলোরা বেগম তাড়াহুড়া করে বিপ্লবের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। বিপ্লব তখন বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইলোরা বেগম জিজ্ঞেস করে
-এতো সকালে কোথায় যাবে, বাবা ?
-মিছিলে।
ছেলের মুখে মিছিলের কথা শুনে ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার মুখ। হৃদয়ের ভিতরে হু হু করে ওঠে। ভীতরে কী যেন এক সংশয় কাজ করে। সে বিপ্লবকে বলে
- বাবা, আজ না গেলে হয় না? বিপ্লব আস্তে আস্তে বলে
- তাই কী হয়, মা ? অনেকে পথ চেয়ে আছে। আমি থেমে গেলে থেমে যাবে হাজার মানুষের কন্ঠস্বর। ভেঙ্গে যাবে এতো দিনের সাজানো গোছানো পরিকল্পনা।
ইলোরা বেগম কিছু একটা বলতে গিয়েও বলে না। নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকে। মনে মনে কিছু একটা ভাবে। বিপ্লব ধীরে ধীরে মিশে যায় মিছিলে, রণাঙ্গনে। সেই যে সে গেলো আর কোনদিন ফিরে এলো না মায়ের কোলে।
৩.
স্টেশনকে পেছনে রেখে পরিত্যাক্ত রেল লাইনের স্লিপারের উপর দাড়িয়ে প্যান্টের জিপার খুলে পেশাব করতে করতে, হো হো হাসতে হাসতে, বিড়ি টানতে টানতে টনি পাগল বলে-
‘আমাকে যারা পাগল বলে, তারাই পাগল’।