যার দিকে কম্পাসের মতো মনটা হেলে থাকে
ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
এক
আজ পড়ন্ত বিকালবেলায় মোবাইলটা হাতে নিতেই একটি ছবি ভেসে উঠল। দেখলাম, আমার প্রাক্তন কর্মস্থলের প্রাক্তন সহকর্মী প্রফেসর মো. আমজাদ হোসেন সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিমুক্ত হচ্ছেন। সরকার বাহাদুর উনাকে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পদে পদায়ন করেছে। উনি ঐ পদে যোগদান করতে যাচ্ছেন। দেখলাম, উনার মনটা বিষণœতায় ভরা। কিন্তু কেন? বিভাগ থেকে সাধারণত শিক্ষকেরা হাসতে হাসতে প্রশাসনিক পদে গিয়ে যোগদান করে। এমনকি ঐ পদে যাওয়ার জন্য অনেকেই অনেক অন্যায় ও অবৈধ পন্থাও (ঘুষ) অবলম্বন করে বলে শোনা যায়। এমন একটি প্রশাসনিক পদ পেয়েও প্রফেসর আমজাদ হোসেনের মনটা বিষণœ কেন? বিষণœ এই জন্য যে, তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদেরকে রেখে তাকে আরেকটি কর্মস্থলে চলে যেতে হচ্ছে। যত সহজে বলে ফেললাম বিষয়টি আদৌ অতো সহজ নয়।
দুই
একদা আমার এক নবীন নারী সহকর্মীকে প্রস্তাব করেছিলাম-চলুন, অধ্যক্ষ স্যারের চেম্বার থেকে একটু ঘুরে আসি। উনি জবাব দিয়েছিলেন-ঐ জায়গায় কি মানুষ যায়? আমি তো হতভম্ব। কিছু সময় হা করে ঐ সহকর্মীর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতায় দেখেছি, কতিপয় শিক্ষক কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কিঞ্চিত সুযোগ-সুবিধার আশায় অনেক সময় অনেকটা এতিমের মতো প্রশাসনিক বিল্ডিং এর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কিন্তু প্রফেসর আমজাদ হোসেন নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন কলেজের উত্তর সীমান্তঘেষা তার বাংলা বিভাগে। এখানেই তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে দিতেন। এখানেই তিনি কমবেশি কুড়িটি বসন্ত কাটিয়েছেন।
তিন
বাংলা বিভাগে কত নবীন প্রাণের আগমন ও প্রস্থান ঘটেছে। এইসব নবীন প্রাণের সঙ্গে প্রফেসর আমজাদ হোসের প্রাণের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি শিক্ষার্থীদেরকে সন্তানতুল্য করে হৃদয়ে তুলে নিতে পারতেন; বন্ধুর মতো করে গ্রহণ করতে পারতেন। তার মধ্যে বিনয়, নম্্রতা, উদারতার মতো মহৎ গুণাবলির সমাবেশ ও সন্নিবেশ ঘটেছিল। সহজেই তিনি শিক্ষার্থীর মনের অন্দরমহলে পৌঁছে যেতে পারতেন। সহজেই ওদেরকে আপন করে নিতে পারতেন। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদেরকে কখনো আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না; অপমান করে কথা বলতেন না। শিক্ষার্থীরাও একাডেমিক পড়াশোনার বাইরেও ব্যক্তিগত নানা বিষয়াদি নিয়ে বন্ধুর মতো করে প্রফেসর আমজাদ হোসেনের সঙ্গে শেয়ার করতে পারতো। বন্ধুর মতো করে, একজন প্রকৃত অভিভাবকের মতো করে ছাত্রছাত্রীরা তাদের শিক্ষককে হৃদয়ের মনিকোঠায় তুলে রাখতো। এখনো রাখে। এই পদায়নে বর্তমান শিক্ষার্থীরা কষ্ট পাচ্ছে এই জন্য যে, তারা তাদের একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারাচ্ছে। আর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা খুশি এই জন্য যে, তাদের প্রিয় শিক্ষক একটি ভালো অবস্থানে যাচ্ছে। তাকে সোসাল মিডিয়ায় দেখা না গেলেও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন বার্তায় তার ছবি ও সংবাদে সোসাল মিডিয়া ছেয়ে গেল। এটি সত্যি যে, শিক্ষার্থীরা তাদের এই প্রিয় শিক্ষককে গভীরভাবে অনুভব করে।
চার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শিক্ষা সম্পর্কিত প্রবন্ধনিবন্ধে শিক্ষকের যে সব গুণাবলির কথা বলেছেন তার প্রায় সবগুলোই প্রফেসর আমজাদ হোসেনের মধ্যে দেখতে পেয়েছি। তিনি একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীদেরকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করতেন তেমনই তার সহকর্মীকেও তিনি বন্ধুর মতোই গ্রহণ করতেন। তার মতো একজন সহকর্মী পাওয়া সত্যিই বড় ভাগ্যের ব্যাপার। অন্তত যারা তার সঙ্গে কিছুদিন চাকরি করেছেন তারা নিশ্চয়ই এই সত্য স্বীকার করবেন। আমি কমবেশি নয় বছর তার সঙ্গে এডওয়ার্ড কলেজে কর্ম করেছি। নয়টি পদে আমরা নয় জন ছোট ভাই-বড় ভাইয়ের মতো এক সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেছি। কোনোদিন স্যার এতোটুকু শক্ত করে আমাদের সঙ্গে কথা বলেননি। একই সঙ্গে তিনি তার শিক্ষার্থী ও সহকর্মীকে দারুণভাবে আপন করে নিতেন। মনে হয়-যদি তার সঙ্গে আবারো কাজ করার সুযোগ পেতাম! যেখানেই কর্ম করি আজো তার অভাব অনুভব করি। আজো কম্পাসের কাটার মতো মনটা তার দিকে ঠেলে থাকে।
ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
শিক্ষক, গবেষক