ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মীর : ঝরছে রক্ত
ইয়াহিয়া নয়ন
শত বছর আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বুনে গেছে এমন সব সমস্যার বীজ, যা স্বাধীনতার বহু দশক পরেও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের রূপে দেখা দিয়েছে। এই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ হলো ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর। দুই ভিন্ন ভৌগোলিক প্রান্তে অবস্থিত হলেও উভয় অঞ্চলের ইতিহাসে একটি বিষাক্ত সাদৃশ্য রয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিভাজনের শিকড় থেকে জন্ম নেওয়া এক দীর্ঘস্থায়ী, জটিল এবং সহিংস বাস্তবতা। যা মুসলমানের রক্তে লেখা এক ইতিহাস।
আজ ফিলিস্তিনে যা ঘটছে, তা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলেই, যখন ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। অথচ সেখানে তখন বসবাস করত মুসলিম ও খ্রিস্টান আরবগণ, যারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের ওপর ম্যান্ডেট লাভ করে এবং ইহুদি অভিবাসনকে উসকে দিতে থাকে।
ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য সমর্থনের নিশ্চয়তা এই বেলফোর ঘোষণা। এটি মূলত ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলুফোরের লেখা একটি চিঠি। ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রথসচাইল্ডকে। এ ঘোষণার পর থেকে ক্রমে ইহুদিরা সে অঞ্চলে ইসরায়েল রাষ্ট্র্র গঠন করে তাদের ভূখ- বৃদ্ধি করতে থাকে। অপরদিকে ফিলিস্তিনিরা ক্রমে ভূখ- হারাতে থাকে। এখনও সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ইহুদীদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনের জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দিবে। যদিও রোমান সময় থেকে ইহুদিদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সে জায়গায় বসবাস করতো।
বেলফোর ঘোষণা তৈরি করা হয় ২ নভেম্বর ১৯১৭ তারিখে। তার এক সপ্তাহ পর ৯ নভেম্বর ১৯১৭ চিঠিটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘বেলফোর ঘোষণা’ পরবর্তীতে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে সেভ্রেস শান্তি চুক্তি ও ফিলিস্তিনের মেন্ডেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূল কপিটি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখ-ে আসতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনি আরবরা বুঝতে পারে যে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। ফিলিস্তিনি আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছে ব্রিটিশ সৈন্যরা।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখন্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। তবে আরবরা সে এলাকার সংখ্যাগুরু হওয়ার পরেও কম ভূমি দেওয়ায় সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। এরপর নানা ঘটনায় ক্রমে ইসরায়েলিদের কাছে ভূমি হারাতে থাকে ফিলিস্তিন। এখন খুব কম ভূমিই অবশিষ্ট আছে।
১৯২২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে সংঘাতের পর, যেখানে উভয় সম্প্রদায়ই আত্মনিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল, যুক্তরাজ্য ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিন থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহারের ইচ্ছা ঘোষণা করে এবং জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদন করে, যা ব্রিটিশ ম্যান্ডেটকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। এই পরিকল্পনাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক গৃহীত হলেও, আরবরা প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৯৪৮ সালের মে মাসে ব্রিটিশ বাহিনী প্রত্যাহারের সাথে সাথে, ইসরায়েলের জন্ম হয় এমন একটি অঞ্চলে যেখানে সীমান্ত, নিরাপত্তা, ভূমি মালিকানা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে। সেই সময় থেকে ইসরায়েল বিভিন্ন আরব বাহিনীর সাথে বেশ কয়েকটি সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৪৮-৪৯, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩, ১৯৮২, ২০০৬ এবং ২০২৩ থেকে এখন পর্যন্ত।
ইতিহাস থেকে এটা পরিস্কার যে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা অঞ্চলটি ত্যাগ করার সময় ইসরায়েলের জন্ম হয় এবং সাথে সাথে শুরু হয় ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিজভূমি থেকে বিতাড়িত হন, যাদের উত্তরসূরিরা এখনো প্রতিবেশী দেশের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূলেই রয়েছে এই ঔপনিবেশিক পুনর্বিন্যাস যার কোনো ন্যায্যতা ছিল না এবং আজও যার জন্য ফিলিস্তিনের শিশু, নারী, ও পুরুষেরা প্রাণ হারাচ্ছেন।
কাশ্মীরের ইতিহাসও প্রায় একই রকম। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেবার সময় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। কিন্তু এই বিভাজন ছিল তাড়াহুড়ো ও অপরিকল্পিত এবং তার ফলে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ দাঙ্গা ও গণহত্যা। এই বিভাজনের মধ্যেই ঝুলে পড়ে কাশ্মীর নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখ-। কাশ্মীরের মহারাজা হিন্দু হলেও প্রজাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলিম। ভারত-পাকিস্তান দু’দেশই কাশ্মীর দাবি করলে সেখানে শুরু হয় প্রথম যুদ্ধ, যার ফলে নির্ধারিত হয় ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’। কিন্তু মূল সংকট থেকে যায় কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অমীমাংসিত প্রশ্ন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর রাজ্যটি পাকিস্তানের ভাগে পড়বে বলেই জিন্নাহ প্রত্যাশা করেছিলেন; কিন্তু তা হয়নি। বিষয়টি অমীমাংসিত থাকায় প্রিন্সলি স্টেটটি সে সময় থেকে অদ্যাবধি একটি স্পর্শকাতর স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সে সময়ে কাশ্মীরের ৮০ ভাগ লোক মুসলমান হওয়ায় নীতিগতভাবে কাশ্মীর পাকিস্তানের প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও নেহরু তা হতে দেননি। রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে নেহরু চেয়েছিলেন কাশ্মীরকে ভারতের ভেতর রাখতে। তাছাড়া রাজ্যটিতে তার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার কারণও ছিল। এ অবস্থায় কাশ্মীরকে নিজ নিজ দেশের অন্তর্ভুক্ত করাতে জিন্নাহ ও নেহরু উভয়েই ব্যর্থ হলে কাশ্মীর কৌশলগতভাবে ১৫ আগস্ট স্বাধীন হয়ে গেল এবং কাশ্মীরের হিন্দু রাজা অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় সেখানে অব্যাহতভাবে গোলমাল চলতে থাকল। ফলে কাশ্মীরের গোলমালে স্বাধীনতার বয়স ছিল মাত্র ৭৩ দিন। রাজা হরি সিংয়ের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে ৩ হাজার পাঠান উপজাতি ঝিলম নদী পেরিয়ে কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তান যুক্তি দেখাল কাশ্মীরি জনগণ অত্যাচারী রাজা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাঠান উপজাতিদের ডেকে নিয়েছে। এ অবস্থায় পাঠান উপজাতিরা শ্রীনগরের কাছে এসে পৌঁছলে হরি সিং আতঙ্কিত হয়ে দিল্লির কাছে সামরিক সাহায্যের প্রার্থনা জানান এবং ৪৭ এর ২৪ অক্টোবর পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে শ্রীনগর থেকে পালিয়ে শীতকালীন রাজপ্রাসাদে গিয়ে ওঠেন। এ ঘটনাকে পাকিস্তানি আক্রমণ আখ্যা দিয়ে নেহরু ও মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য পাঠালে ৩৫ হাজার ভারতীয় সৈন্য এসে সেখানকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। কিন্তু হরি সিংয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো চুক্তি না থাকায় বিরোধ লেগেই থাকল। হরি সিং আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করলেন না। ভারত কাশ্মীরে সমাসীন হওয়ার পর নেহরুর বন্ধু শেখ আবদুল্লাহকে রাজ্যের প্রশাসনিক সরকারের প্রধান হিসেবে বসিয়ে দেয়া হলে হরি সিং কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ পরিত্যাগ করে কাশ্মীর থেকে নির্বাসিত হলেন। অতঃপর ১৯৪৯ সালে শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তার দল ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে কাশ্মীর শাসন করতে থাকে।
এরপর থেকে কাশ্মীর হয়ে পড়ে এক সামরিকীকৃত অঞ্চল, যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, এমনকি মানবাধিকারও বারবার লঙ্ঘিত হয়। ২০১৯ সালে ভারতের সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয় এবং সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গৃহবন্দী করা হয়। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এই অসম্পূর্ণ ও অবিচারপূর্ণ অবস্থা আজো মানুষের রক্তপাত, নিপীড়ন ও বঞ্চনার কারণ হয়ে আছে। কাশ্মীরকে ঘিরে নতুন করে শুরু হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এই দুই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যে যে ক্রমাগত বিপর্যয় চলছে, তা কেবল স্থানীয় বা আঞ্চলিক রাজনীতির ফল নয়। এর শেকড় রয়েছে ঔপনিবেশিক নকশায়, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য নয় বরং বিভক্তি ও দাঙ্গা সৃষ্টিই ছিল উদ্দেশ্য। ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ‘উরারফব ধহফ জঁষব’ নীতি প্রয়োগ করেছিল, যার ফলাফল আজো মানুষের রক্তে লেখা হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন আজও অধরা, আর কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি প্রতিনিয়ত সামরিক শক্তির মুখে নিষ্পেষিত হচ্ছে।
আজও যদি ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দায় মেনে নিয়ে এর সমাধানে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে মানবতা প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হতে থাকবে। ইতিহাসকে দায়মুক্ত করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হয়তো এখন নেই, কিন্তু তাদের সৃষ্টি করা এই অসমাপ্ত ক্ষত এখনো মানুষের শরীরে রক্ত ঝরায়। মানুষ মরছে, স্বপ্ন ভাঙছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিপন্ন ভবিষ্যতের ভার বইছে এবং এই দায় শুধু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর নয়, ইতিহাসকেও সে দায় নিতে হবে।
ইয়াহিয়া নয়ন : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ঢাকা, ৯ এপ্রিল ২০২৫