নৈঃশব্দের অন্তরালে’র একটি সহজপাঠ

Dainik Pabna

আব্দুল করিম

প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল করিমের নৈঃশব্দের অন্তরালে : একটি সহজপাঠ

সালেক শিবলু

কোন লেখক বা কবিকে বুঝতে এবং জানতে গেলে নিজের সর্বপ্রথমে সাহিত্য রাজ্যের জ্ঞান থাকা উচিত; আবশ্যিকও বটে। কোনও একটি কবিতা পড়েই বিচার বিশ্লেষণে বসা হাস্যকর প্রয়াস বা অন্ধকারে হাতি দর্শনেরমত কাজ বললে মনে হলে ভুল হবে না। প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল করিম এঁর ‘নৈঃশব্দের অন্তরালে’ গ্রন্থটি পাঠের পর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। নৈঃশব্দের অন্তরালে গ্রন্থটি মহিয়সী প্রকাশ হতে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় । বইটি পড়া শুরু করার পর যত এগোচ্ছি , ততই যেন আরও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একটা বিষয় থেকে আরেকটা বিষয় অবলীলায়, স্বচ্ছন্দে ভাষার সৌকর্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গ্রন্থের পরিসমাপ্তিতে মনের ভেতরে উদ্ভাসিত কিছু ভাবনা একত্রে গাঁথার চেষ্টাই মূলত এই লেখা।

গ্রন্থটিতে গান, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রয়েছে। লেখক জীবন চলার পথে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তাঁর এই গ্রন্থে । কখনো গানে আবার কখনো কবিতায় কথনো গল্পে বা প্রবন্ধে । গ্রন্থটির শুরু বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের আদলে বললে ভুল হবে না মনে হয়। কারণ প্রতিটি মঙ্গল কাব্যই শুরুতে প্রার্থনা দিয়ে শুরু করেছেন কবিরা। ঠিক এই গ্রন্থের শুরু হয়েছ হাম্দ নাত দিয়ে। লেখকের শৈশবে বেড়ে উঠেছেন আবহমান গ্রাম বাংলার শ্যমলিয়া মায়ের কোলে। সেখানে দেখেছে বাংলার চিরায়িত রূপ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর গানে।

এ মাটি আমার মাটি
এ মাটি ফুল ফসলে ভরা
এ আমার দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার গন্ধে আকুল করা।

গ্রন্থকারের অস্থিতে মিশে আছে ইছামতি যমুনা নদী। নদীবিদৌত বাংলাদেশের চিত্রও তাই তুলে এনেছেন কল্পনার রং তুলিতে। সাথে যোগ হয়েছে বাংলার ঋতুবৈচিত্র । নদীতে মাঝিমাল্লার ভাটিয়ালির সুর লেখকের মনকে আন্দোলিত করেছে। এই সুরে মায়ের ভাষার অমৃত খুঁজে পেয়েছেন। তাই শিল্পের উপাদান হিসেবে স্থান দিয়ে তাঁর লেখনিতে। তিনি গেয়েছেন-

এখানে ভাদর মাসে নায়ের মাঝির ভাটিয়ালী সুর
আষাঢ়ে ধানের ক্ষেতে ছন্দ তোলে মেঘের নুপূর
এ দেশে মায়ের ভাষায় মেহন বাঁশির
ছন্দে দোদুল দোলা।

আমাদের জন্মভুমিকে বাংলাদেশ রূপলাবণ্যের স্বর্গ। একেকজন কবি সাহিত্যিক একেক ভাবে নানা ব্যঞ্জনায় এদেশের রহস্যময়ী রূপ তুলে ধরেছেন তাঁদের সাহিত্য সাধনায়। এখনে গ্রন্থকারও তার ব্যতয় ঘটাননি । বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের গান-কবিতা লেখেননি এমন কবি সাহিত্যিক পাওয়া সত্যিই কঠিন। প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল করিমের লেখনিতে উঠে এসেছে তারই চিত্র। মুক্তিযুদ্ধে অনেক মায়ের সন্তান, অনেক বোনের ভাই, ছেলের বাবা যুদ্ধে গিয়েছে কিন্তু আর কোন দিন ফিরে আসে নাই । কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের এই স্বাধীন লাল সবুজের বাংলাদেশ । তারই প্রকাশ দেশে গানে-


ভাইটি আমার সেই যে গেল
ফিরে আইল না…
ও সে রক্ত দিয়ে লেইখা গেল
আমার ঠিকানা, আমার ঠিকানা
অথবা,
ভাইয়ের খুনের আলপনা আঁকা পথ ঘুরে
স্বাধীনতা তুমি এলে
ঝড়ের রাতের মরণ সাগর পাড়ি দিয়ে
স্বাধীনতা তুমি এলে

বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের গান যেমন লিখেছেন তেমন লিখেছেন ভাষা আন্দোলনের গানও। তাঁর একুশের গানে ফুটে উঠেছে বায়ান্নোর ভাষার চেতনা-

একুশ এনেছে দিন বদলের পালা
রক্ত আখরে লিখিয়ে গিয়েছে হৃদয়ের বর্ণমালা।

বাংলার রূপ মোহ যেমন তাঁকে কাছে টেনেছে তেমনই বাঙালির আত্মত্যাগ জয়গান গেছেছেন তার গানের শব্দের দ্যোতানার মধ্যদিয়ে। দেশগানের পর ক্রমানুসারে রয়েছে আধুনিক, গণসঙ্গীত, পল্লিগীতি, বাউল গানের মত গান। যে গানগুলোতে লেখকের বর্নীল সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যেখান থেকে বাদ পরেনি প্রকৃতির ফুল,পাখি,নদ-নদী, গ্রাম-শহর, আন্দন বিরহ. প্রেম প্রীতির ভাঙাগড়ার কথোপকোথন। প্রেমের প্রাপ্তি সবসময় বিরহেই । তাই লেখক লিখেছেন-

জানি সবফুল দিয়ে হয়না মালা গাঁথা
বেদনার নীল আকাশটা জানি চিরদিনই মেঘে ঢাকা ।
আবার লিখেছেন-
ঐ দু’টি চোখে কামনার দ্বীপ জ্বেলে
এসেছিলে কাছে একটি অতীত ফেলে
দু’টি হাত ভরা যত ফুল ছিল
অঞ্জলি ছিল না।


বিশ্বব্রাহ্মান্ডে প্রতিনিয়ত ভাঙাগড়ার স্রোত বয়ে চলছে, এই স্রোতে আমরা প্রতিটি মানুষই একা। মানুষের জীবনতরী এই স্রোতে ভেসে চলে। যে আজ এই জোয়ারে স্রোতে প্রভাত ভেলায় রওনা হল আবার ভাটির টানে তাকে আবার চলে যেতে হবে অচেনা গন্তব্যে । মানুষ ইচ্ছা করলেই এই মহাকালে স্রোতে টিকতে পারে না। সাবার তরী একদিন ভাটির টানে চলে যাবে দূর অজানায়।

জোয়ার-ভাটার উজান স্রোতে সুজন এল সেদিন প্রাতে
ভাটির টানে আজকে সে যায় দূর- অজানার প্রানে…

পল্লির গানে সহজ-সরল শব্দের গাঁথুনিতে গানকে নিয়ে গেছে মাটির কাছাকাছি। গ্রামীণ নানা চিত্র এসেছে অবলীলায়। সহজ কথাকে সহজ ভাবে বলাটা শিল্পের দাবিদার।

বকুল ফুলের মালা গেঁথে আমি ঘুইরা বেড়াই পথে পথে
তারে পাইলে কাছে সেই মালাটি পড়াইতাম গলে।

গানের পরে এই গ্রন্থে কবিতার সংখ্যা রয়েছে ২১টি। প্রতিটি কবিতাই সহজ-সরল সাবলিল ভাষায় লিখেছেন। কবিতার উপাদান হিসেবে কবি বেছে নিয়েছেন আন্দোলন সংগ্রাম । কবিতার মাঝে খুঁজতে চেয়েছেন স্বাধীনতার স্বাদ-

স্বাধীনতার অর্থ খুঁজি নেতার গরম বক্তৃতাতে
স্বাধীনতার অর্থ খুঁজি দিন মুজুরের প্রান্তা ভাতে

কখনো প্রেম, কখনো বিরহ, কখনো প্রকৃতির কোলে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। কবির কবিতার বিশেষ একটা স্থান দখল করে রয়ে এক মায়াময়ী নারী সত্তা । কবি গানে ও কবিতায় তার বন্দনা করেছেন। যেমন করে বাংলা কবিতায় বন্দনা করা হয়েছে বনলতা, সুরঞ্জনা, কৃষ্ণকলি, নার্গিস, সাজু, মাহফুজার । ঠিক তেমন করে কবিও সেই নারীর বন্দনা করেছেন তার কবিতায়-

তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়
সুন্দর ছন্দ মিলানো- কিংবা
গদ্য কবিতায় এক অসম সুন্দর
বাক্য বিন্যাসে।

কবিতা নির্মাণশৈলীর ক্ষেত্রে কবি শব্দালঙ্কাকার ও অন্তমিলের দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। দু’একটি কবিতা বাদ দিলে প্রায় সব কবিতাই শিল্পের মানদন্ডে মহাকালের স্রোত টিকে থাকবে আশা করি। এ ছাড়াও গল্পও প্রবন্ধেও যে লেখকের একটা হাত আছে তা বুঝা যায় তাঁর গ্রন্থের শেষের দিকের রচনা দেখে। গ্রন্থের বিষয়বস্তুর ভাব ও বৈশিষ্টের দিক থেকে গ্রন্থকার নামকরণের দিকে একটু নজর দিতে পারতেন বলে আমার মনে হয়েছে । গ্রন্থটির সহজ পাঠ শেষে যথার্থই বলা যায়-‘ স্বনির্বাচিত এক রহস্যময় জগতে-নির্বাসিত এই শিল্পীর কাব্য ও সুরের মূর্ছনা পাঠক হৃদয়ে আদিম ও অকৃত্রিম পরশ অতি গোপনে ছড়িয়ে দিয়ে যাবে’’।

# সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, ঢাকা।

 

SHARES

ফেসবুকে অনুসরণ করুন

আরো পোস্টঃ