পাঁচ শক্তির কারণেই নির্বাচন অনিবার্য-মোশাররফ হোসেন মুসা

Dainik Pabna

পাঁচ শক্তির কারণেই নির্বাচন অনিবার্য

মোশাররফ হোসেন মুসা

আমাদের সান্ধ্যকালীন আড্ডায় বিভিন্ন পেশার মানুষ বসেন। আড্ডায় রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। আড্ডায় মাঝেমধ্যে এমন কিছু নিয়ে আলোচনা হয়, যা রীতিমতো গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সিরাজুল ইসলামের ‘পাঁচ শক্তি’ নামের একটি তত্ত্ব গবেষণার খোরাক হয়েছিল। সিরাজুল ইসলাম ১৯৮৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগ থেকে অনার্স ডিগ্রি নেন ; কিন্তু তিনি আইন পেশায় না গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বর্জিত তুলা ক্রয়- বিক্রয় থেকে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে পূর্ণতা ফ্লাওয়ার মিল নামে একটি মিল স্থাপন করেন। একাগ্রতা ও বিচক্ষণতার কারণে তিনি ব্যবসায় সফলতা লাভ করেন। তো ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আওয়ামী লীগ জয়ী হলে আড্ডার সদস্যের অধিকাংশ মতামত দেন- এ সরকার ৬ মাস স্থায়ী হবে।

সিরাজুল ইসলাম বলেন – আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতি পাঁচ শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। পাঁচ শক্তি হলো; ১) পরাশক্তি ; ২) সামরিক বাহিনীর শক্তি ; ৩) ধনিক শ্রেণীর শক্তি ; ৪) ধর্মীয় শক্তি ও ৫) সবশেষে জনগণের শক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাঁচ শক্তিকে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় সপরিবারে নিহত হন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা জানেন পাঁচ শক্তিকে কীভাবে সমন্বয় করতে হয়। সেকারণে এ সরকার টিকে যাবে এবং তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এ বিষয়ে তৎকালীন সময়ে ‘ পাঁচ শক্তি’ শিরোনামে ৩৫০ শব্দ বিশিষ্ট একটি অনু কলাম লিখে বিভিন্ন পত্রিকায় দিলে তা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয় ( ‘পাঁচ শক্তি’ লিখে নেটে সার্চ দিলে লেখাটি এখনো পাওয়া যাবে)। তারপর থেকে বন্ধুমহলে তাঁর নাম হয়ে পড়ে ‘পাঁচ শক্তি’।

গত বছর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁর মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন- ধনিক শ্রেণী ছাড়া আর চার শক্তি তাঁর পিছন থেকে সরে যাওয়ায় তার পতন ঘটেছে এবং দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সেসময় জনগণ তিন-চার দিন এক লাফে এক নম্বরে চলে এসেছিল। তারপর পুর্বের মতো পাঁচ নম্বরে নেমে আসে। বর্তমানে সকল স্থানে আলোচনার বিষয় একটাই আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রয়ারী মাসে সংসদ নির্বাচন হবে কি না ! টক্ শোতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরা মতামত দিচ্ছেন ফেব্রয়ারিতে নির্বাচন হবে না এবং বিভিন্ন টাল বাহানায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকবেন।

এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলামের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি পুনরায় একই তত্ত্ব দেন ; তথা পাঁচ শক্তির কারণেই বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবেন। তাঁর কথার সংক্ষিপ্ত ব্যাখা হলো- গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড.মুহম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা পদে বসানো হয় পরাশক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার স্বার্থে( তিনি নবেল বিজয়ী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী তাঁর পরিচিতি রয়েছে) । কিন্তু তিনি বিমানবন্দরে নেমে বলেন- ‘ছাত্রদের অনুরোধে আমি ক্ষমতা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছি’৷ সেদিন থেকে জনগণ বাদ পড়ে ৷ আন্দোলনকারী ছাত্ররা ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ায় এবং তাদের বিভিন্ন ভুল বক্তব্য ও বালখিল্য কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের জনপ্রিয়তা এখন শুন্যের কোঠায়। পরাশক্তির সমর্থন আগের মতো নেই। বলা যায়, তিন-চতুর্থাংশ তাঁর পিছন থেকে সরে গেছে। সামরিক শক্তির ভূমিকা রহস্যজনক। ধনিক শ্রেণীর সমর্থন অর্ধাংশ।

ধর্মীয় শক্তির সমর্থন পুরোপুরি আছে( তবে একসময় ধর্মীয় শক্তি বিভক্ত হয়ে যাবে) । জনগণ দ্বিধাবিভক্ত। এখানে উল্লেখ্য, যারা পরাশক্তির ক্ষমতার কথা অস্বীকার করছেন, তাদের জন্য পাকিস্তান উদাহরণ হতে পারে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় রোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে সকল প্রটোকল ভেঙে ডিনারের নিমন্ত্রণ করেন। পাক সেনাপতি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নবেল পুরুষ্কার দেয়ার জন্য সুপারিশ করেন। কাজেই যারা জুলাই আন্দোলনে পরাশক্তির ভূমিকা ছিল না বলে মন্তব্য করছেন,তারা কল্প লোকে বসবাস করছেন। সেজন্য যতদিন যাবে নৈরাজ্য বৃদ্ধি পাবে এবং সরকার বিভিন্ন কর্নার থেকে সমর্থন হারাতে থাকবে। বিএনপি নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে।

সেসঙ্গে জনগণের অধিকাংশ নির্বাচন চাচ্ছে। এমতাবস্থায় নির্বাচন অনিবার্য। জামায়াত ইসলামী সহ কয়েকটি দল যুক্তি দেখাচ্ছে, দেশে নৈরাজ্য চলছে, নির্বাচন করার মতো পরিবেশ নেই। তারা আরও বলছে – বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচার আগে করতে হবে এবং সংস্কার আগে সম্পন্ন করতে হবে – তারপর নির্বাচন। তাদের উচিত ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমেদ সরকারের আমলের কথা স্মরণে আনা। ফখরুদ্দীন সরকার সারা দেশে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে নামে। দুইনেত্রী সহ অসংখ্য নেতা-কর্মীকে আটক করে। ক্লিনহার্ট অপারেশনে যৌথবাহিনীর হাতে শতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হয়।

বর্তমানে যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তারাও তদ্রুপ সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ছবিযুক্ত ভোটার আইডি কার্ড ও বিচার বিভাগ পৃথককরণ তাদের অন্যতম কৃতিত্ব। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো বড় দলগুলি তাদের বিরুদ্ধে থাকায় তারা দ্রুত জনসমর্থন হারাতে থাকেন। বিশেষ করে ধনিক শ্রেণীর অসহযোগিতার কারণে চাউলের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তখন সেনা প্রধান মইন ইউ আহমেদ পরামর্শ দিয়েছিলেন- বেশি করে আলু খান । বর্তমানে সেরকম পরিস্থিতি দেখা দিলে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ধনিক শ্রেণী যে অনুরূপ কাজ করবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়! প্রশ্ন এসে যায়, তাহলে কি জুলাই বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে ? পাল্টা প্রশ্ন হবে – জনগণকে এক নম্বরে রাখার উদ্দেশ্যে কি কোনো কর্মসুচি গৃহীত হয়েছিল? জনগণকে একনম্বরে রেখে কি সরকার ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল? উত্তর- অবশ্যই না। এটা জুলাই আন্দোলনে যেমন সত্য, তেমনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন সহ ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বেলাতেও সমানভাবে সত্য। তবে জুলাই আন্দোলনে তিন-চার কোটি তরুণ প্রতারিত হলেও তারা ভবিষ্যতে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। তারা আবারো জেগে উঠবে – এটাই আমাদের বড় প্রত্যাশা।

লেখক: মোশাররফ হোসেন মুসা, গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।

SHARES

ফেসবুকে অনুসরণ করুন

আরো পোস্টঃ