কৃষিখাদ্যে বিষাক্ততা এবং কৃষকের স্বাস্থ্য

Dainik Pabna

কৃষি খাদ্যে বিষক্ততা

কৃষিখাদ্যে বিষাক্ততা এবং কৃষকের স্বাস্থ্য 

গৌতম কুমার রায়

গত ৫ এপ্রিল পালিত হয়ে গেল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের বা দেশের অর্থনীতির মূল চালক হিসেবে কৃষকের স্বাস্থ্য কেমন আছে, কেমন ভাবছে তাদের স্বাস্থ্য সেবার পরিসর নিয়ে আমাদের দেশ। কেননা আমাদের খাদ্য ও অর্থ যোগানদাতা কৃষক। কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত প্রায় ৩ কোটি কৃষকের শ্রম ও মেধার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবস্থানের বিনিময়ে ১৫ কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মৌলিক চাহিদা মিটে থাকে। কেমন আছে আমাদের সেই কৃষকেরা। কেমনইবা আছে আমাদের দেশের আপামর মানুষের জনস্বাস্থ্য। কৃষকের যতটুকু নিয়ে আমাদের চাল-চলন, বিনিময়ে তাতে কিইবা পায় তারা। খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার সাথে কেমন তাদের স্বাস্থ্য পরিসেবা।


তবে আমাদের কৃষকেরা ভাল নেই। কেননা এ দেশের কৃষকের চেহারায় মলিনতা, চোখে-মুখে আতঙ্ক আর অভাবের স্পষ্ট ছাপ। রোগাক্রান্ত শীর্ণ তাদের দেহ। রোগ-শোক তাদেরকে আষ্টে-পিষ্টে রাখে সারাক্ষণ। সার্বিক পরিবেশের অবক্ষয়ে বছরের পর বছর বাংলাদেশের কৃষকেরা। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, জল দূষণ যখন আমাদের নিত্য সাথী, তখন কৃষিতে পাওয়ার টিলার, হাইব্রিড বীজ, ট্রাক্টর, রাসায়ানিক সারের ব্যবহারে জমিতে উচ্চ মাত্রার ফসফরাস,তামা, দস্তা, বোরন, নাইট্রোজেন, জৈবিক পদার্থের পরিমাণ। এন্টিবায়োটিক, রাসায়ানিক কীটনাশকের ব্যবহার, জলের বিষাক্ত আর্সেনিক, ফরমালিনের ব্যবহারে খাদ্যদ্রব্যে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা যখন হুমকির মুখে তখন আমাদের কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত। কৃষকের অসুখ-বিসুখে দেখার কেউ না থাকলেও তাদের নিত্যদিনের কাজকর্ম সবসময় ঝুঁকির মধ্যে প্রবাহিত।


চাষাবাদে জমিতে গবাদি পশুর ব্যবহার করে তাদের চুনা ও গোবরে জমিতে উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পেত। এখন সেই জমি পাচ্ছে পোড়া ও কাঁচা মবিল এবং জ্বালানী। দ্রুত ও উচ্চ বর্ধনশীল এন্টিবায়োটিকের বদৌলতে মাংশ জাতীয় খাদ্য পাচ্ছি বটে, প্রকারান্তে সেই এন্টিবায়োটিককে আমাদের শরীরে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছি। যে কারণে মানুষ দীর্ঘ প্রসারি এন্টিবায়োটিক টেম্পার দেহে পুষে অসুস্থ্য হয়ে মারাও যাচ্ছে। কীট-নাশকের মত রাসায়ানিক দ্রব্য শাক সব্জিতে ব্যবহার করে তার বিষ প্রতিদিন আমাদের শরীর গ্রহণ করে আসছে। মাছে, মাংশে ও দুধে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর ফরমালিন ব্যবহার করার জন্য আমাদের সুস্থ্য জীবন যাপন করা দূরহ হয়ে পড়েছে। দেশের কৃষকেরা এই সকল ক্ষতিকর দ্রব্য শুধুমাত্র ব্যবহার করতে গিয়েই জীবনে বহন করে ঝুঁকির ভয়াবহ মাত্রা। আর খাদ্য গ্রহণ করার সময় নিজে নিজের দেয়া বিষ ভক্ষণ করে নিজের সর্বনাশ নিজেই করে থাকে। দেশে প্রচলিত বৃটিশের চা খাওয়ানো গল্পের মত।


স্বাধীনতার পরে এদেশে কৃষিতে প্রথম ১৯৭৪ সালে বালাইনাশকের জন্য মানব দেহের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার বিনামূল্যে বিতরণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। ভেজাল ও উচ্চমূল্যেরসহ এখন দেশে প্রতি বছরে প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন বালাইনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউরিয়া সারের পাশাপাশি জমিতে কৃষকেরা ব্যবহার করে থাকেন ন্যালিডিকার্ড, প্যারাথিন, মিথাইল, ক্লোরডেন, সিনডেন, ক্যামফ্লিকোর, ডিডিটি, পিসিপি, হেপ্টাকোর, ডিপিসিবি প্রভৃতি নামের ‘ডার্টিডজন’ খ্যাত জনস্বাস্থ্যে অতি ক্ষতিকর কীটনাশক। আমরা শুধুমাত্র খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে গ্রহণ করলেও, কৃষকেরা ঘাতক বিষের প্রভাব শরীরে গ্রহণ করে দুই ভাবে। আবার সরাসরি ব্যবহারে নাড়াচারা করতে গিয়ে তার যে প্রভাব কৃষকের শরীরে বাসা বাঁধে, তার ভয়াবহতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে তাকে। মাংশের পরিবর্তে যখন সব্জি খাদ্যের দিকে মানুষ বেশী মাত্রায় ঝুঁকে পড়ছে, তখন সবজিকে সতেজ ও পোকামাকড় হতে রক্ষা করতে গিয়ে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এই বালাইনাশকের ব্যবহার আমাদের জীবনের জন্য মরণের সন্ধিক্ষণ তৈরী করে দেয়


জমির উপর অস্বাভাবিক আচরণসহ প্রতিকূল বাস্তবতায় মানুষ অভাবের প্রয়োজনে বেশি ফলনের জন্য এক বা দো ফলা জমিতে এখন তিন-চার অর্থাৎ বিরামহীন চাষাবাদ ঘটিয়ে জমির শক্তিকে কঙ্কালসার বানিয়ে ফেলছে। আবার জমির বীজ নির্ণয়ে স্থানীয় জাতের পরিবর্তে এসেছে হাইব্রীড বা উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ। এই বীজের ফলনের জন্য মাটির শক্তি, রসসহ মৌলিক উপাদানের উপর যে চাপ পড়েছে, তাতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ যোগান দিতে পাড়ছে না মাটি। মাটির পুষ্টি সরবরাহের জন্য কেমিক্যাল সারের প্রয়োগ করা এখন নিত্য-নৈমিত্ত্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসায়ানিক সারের ব্যবহারে জমির নিজস্ব শক্তি হারানোর পাশাপাশি মাটি এবং তার ফলানো ফসলে দেখা দিয়েছে নানাবিধ রোগব্যাধি। যে জন্য ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ, রোগ বালাই থেকে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে জমিতে দিতে হচ্ছে ক্ষতিকর কীটনাশক বিষ। অর্থাৎ খাদ্যের যোগান দিতে গিয়ে মানুষ তার স্বকীয়তাকে হারিয়ে যা পাচ্ছে তাতে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে বিষ এবং এতে নি:শেষ করে দিচ্ছে তার শারীরিক শক্তি কাঠামোকে।


দেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হলেও আমাদের কারণে তা হয়ে উঠছে ভয়ংকর আতংকের বিষয়। কৃষকের পাশাপাশি অনাহারি জাতি পাচ্ছে রোগ তৈরির উপাদান। কৃষিজ রিসোর্সগুলো তার সাবলিল শক্তি হারিয়ে ফেলছে। মাটি, জল, বায়ু, আলো যে স্বকীয়তা নিয়ে কৃষি উৎপাদনে অবদান রাখার কথা, তা না হয়ে এ ক্ষেত্রগুলো আজ ধারাবাহিকভাবেই উর্বরতা বৃদ্ধির নামে শক্তির স্থায়ী শেলগুলো শুধুমাত্র কীটনাশক ও রাসায়ানিক শক্তির ব্যবহারের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্যবহার পদ্ধতি না জানা, মাত্রা নির্ণয়ে অজ্ঞতা, ক্ষতির কারণ সম্পর্কে অবহিত না থাকাসহ অন্যান্য কারণে প্রয়োগকারী হিসেবে প্রথম বলির শিকার হতে হচ্ছে আমাদের কৃষককে।


বালাইনাশকের যত্রতত্র ব্যবহারের জন্য মাটি হারিয়েছে তার অণুজীব, প্রাকৃতিক মৎস্য হারিয়েছে প্লাংটন, কৃষি ও পরিবেশ বান্ধব পোকামাকড় ধ্বংস হয়েছে। কেননা এমনও কীটনাশক রয়েছে যার ক্ষতিকর প্রভাবিত মাত্রা একবার ব্যবহারে ৩০ বছর পর্যন্ত স্থির থাকে। যেভাবে তার ব্যবহার হচ্ছে এ দেশে তাতে আমরা যুব ও পৌর বয়সের মানুষেরা এখনও যে বেঁচে আছি তা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়। গ্রামীণ মানুষ অথবা বিশেষ করে কৃষকের শরীরের বেহাল অবস্থা কেন এমন তার কোনো কারণ খোঁজা না হলেও এটা বলা যায় সার্বক্ষণিক ঘাতকের পরিবেশের সাথে বাস করার জন্যই তাদের এ অবস্থা। বালাইনাশকের প্রভাবে দেশের মানুষ যেমন অনেক রোগাক্রান্ত আবার কৃষকের দিকে তাকালে দেখা যায় আরো ভয়ংকর পরিস্থিতি। মাথার চুল পড়া, স্কীন ডিজিস, ক্যন্সার, আলসার, অন্ধত্ব, প্যারালাইসিস, সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারান, পঙ্গু সন্তান জন্ম দেওয়ার মত নানা জটিল রোগের কারণ। এই কীটনাশকের জন্যই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ঘরে ফিরে ক্ষুধার্থ কৃষক যা খায় তাতেও এ বিষের অবস্থান। ঘরের ফল পাকাতে যে রাসায়ানিক উপকরণ ব্যবহার হয়ে থাকে তা ফলের খোসার সুক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে রসালে প্রবেশ করে। ফলে ঐ ফল খেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। যে কারণে পেটের পীড়া, লিভার ও কিডনীর সমস্যার কারণ।


সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে ফরমালিন ও ক্লোরো কার্বণ গ্যাস। মাছ, মাংশ, দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যে এগুলোকে মিশিয়ে দিয়ে অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। বিশেষ করে বস্ত্র কারখানায় ব্যবহৃত লাল ও কমলা রং দিয়ে বিভিন্ন মাছকে রাঙিয়ে রাখা হয়। যা ক্রেতার চোখ আকৃষ্ট করলেও এগুলোতে থাকে বিষ। যে জন্য বাচ্চাদের স্মৃতি শক্তি হ্রাস, এলার্জি, ক্যান্সারসহ ভয়াবহ জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এমনকি মেয়েদের অসময়ে গর্ভপাত ও সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। তবে এতটুকু নির্দিধায় বলা যায়, ফরমালিন ও ক্লোর কার্বণের কোনো উপাদান পেটে বা শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সার একশত ভাগ নিশ্চিত।


দেশের সিংহভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে। তারা জানেনা কিভাবে স্বাস্থ্য সচেতনতায় জীবন-যাপন করতে হয়। এই মানুষের মধ্যে বেশির ভাগই কর্ম করে কৃষিতে। অর্থাৎ কৃষকের জীবন ঝুঁকির মধ্যে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই কৃষকেরাই না জেনে ব্যবহার করছে বিভিন্ন কাজে বিষাক্ত উপাদানগুলো। যেজন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে রোগ-শোকের মধ্যে তাদের বসবাস। তেমন বিশেজ্ঞ চিকিৎসক নেই গ্রাম পর্যায়ে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও সুখে নেই কৃষক ও তার পরিবার। তাই সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে এবং আইনের কঠোর বিধান প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল বিরোধী কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে না পাড়লে নি:রোগ জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিযে রাখা সম্ভব হবে না।

লেখক : গবেষক, উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী। কুষ্টিয়া

 

SHARES

ফেসবুকে অনুসরণ করুন

আরো পোস্টঃ