সালেক শিবলু
সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে কাব্যভাষা দায়বদ্ধ। দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অবস্থান ও অস্তিত্বকামী দ্বান্দ্বিক জীবনকে কেন্দ্র করেই লোকচেতনায় রাজনৈতিক বোধের সঞ্চার হয়। প্রকৃত অর্থে, সমাজবোধ ও রাষ্ট্রীয় অধিকার-চেতনার অনুষঙ্গে এ বোধের পরিণতি পায়। বৃহত্তর জনসমাজের রাজনৈতিক চেতনা তাই অনিবার্যভাবে প্রবেশ করে শিল্পের শিরা-উপশিরায়। একজন কবি মাকড়শার মত শব্দের বুনটে আটকে ফেলেন তাঁর সময়, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে। এই শব্দ সাধনায় নিপূণতার পরিচয় দিয়েছেন কবি মজিদ মাহমুদ। বাংলা কাব্যভুবনে তিনি হেঁটেছেন নতুন পথে নতুন রথে। ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যের মধ্য দিয়ে পাঠক মহলে স্থান করে নিলেও তাঁর পরবর্তী কাব্যগুলো মাহফুজামঙ্গলকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৭ সালের প্রকাশিত ‘কাটাপড়া মানুষ’ তার মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে ‘বল উপাখ্যান’,‘আপেল কাহিনি’, ‘গোষ্ঠের দিকে’, ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’ প্রভৃতি কাব্যের বিষয় ভাবনার চেয়েও নানা প্রেক্ষাপটে গুরুত্বের দাবিদার ‘কাটাপড়া মানুষ’।
প্রতিটি ভাষা-সাহিত্যে দ্রোহ শব্দটি ভাবগত এবং প্রকাশগত দুটি দিক থাকে। যা নিগৃঢ় উপলব্ধি এবং স্বাতন্ত্র-চেতনা। যা কখনোই বিচ্ছিন্ন নয় বরং একটি আর একটির পরিণতি। আটপৌরে ভাব যেমন আটটপৌরে কল্পলোকের সৃষ্টি করে ঠিক তেমন স্বতন্ত্র ভাবচেতনা প্রকাশেও নিয়ে আসে অভিনবত্ব। দ্রোহের মূল উৎস হলো কবির একান্ত কল্পলোক। সেখানে দ্রোহের জমাট না বাঁধলে তার প্রকাশের দ্রোহ কখনো খাঁটি হতে পারে না। যাপিত জীবনের গতানুগতিকতার বিরোধিতা অথবা সমাজ-সভ্যতা, দেশ-রাষ্ট্রের পারিপার্শ্বিক সমালোচনা কখনো সাহিত্যে-শিল্পে দ্রোহ বলে স্থান পেতে পারে না; কারণ তা সত্যিকার সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়। আমাদের যাপিত জীবনের চাওয়া-পাওয়া, আকুতির, সংঘাত-সংঘর্ষ যেমন যথার্থ তেমন তার সমাধানের পথ আবিষ্কারও মানব জীবনের অবিরাম প্রচেষ্টা। আর আদি-অন্তকালের সকল মহৎ সাহিত্যে এ প্রচেষ্টার প্রতিফলন। তাই জীবন বাঁকের সমস্যা সমাধানের পথে জন্ম হয় দ্রোহের। এ দ্রোহের গভীর জীবন-জিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত শিল্পকর্মের শিল্পকে দ্রোহীর তকমা ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আর এই দ্রোহ সবসবময় মানবাত্মারই অনুষঙ্গ, যা সমাজ সভ্যতারই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সমাজ-সভ্যতাকে অক্সিজেন দিয়ে সচল ও সজীব রাখার জন্যেই সাহিত্যে দ্রোহ অত্যাবশ্যক। ‘কাটাড়া মানুষ’ কাব্যে কবির দ্রোহের দিকটি পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়েছে শব্দের ব্যঞ্জনায় ও ভাবে।

কাব্যের শুরুতে ‘কবিতা’ নামী কবিতায় দেখি শব্দের গাথুনিতে গেঁথে দিয়েছেন কবি তার আত্মপোলব্ধি। কবিতা সবসময় মাঠে-ঘাটে মিছিলে সংগ্রামে জন্য, খালিপায়ে ফুটপাতে হাঁটার জন্য, সারিবদ্ধভাবে গর্মেন্টেস কারখানায় যাওয়ার জন্য। আমাদের যাপিত জীবনে কবিতা এমনই। এমনই কবিতা আমাদের প্রত্যাশা। অন্য কবিরা যখন ফুল-পাখি নারীর সৌন্দর্যের উপমার মধ্যে থেকে বের হতে পারেনি তখন মজিদ মাহমুদ দেশকালের বিবেচনা না করে বের হয়ে এসেছেন দ্রোহের মশাল হাতে। তার দ্বীপ্ত উচ্চারণÑ ‘যারা সহমরণে অগ্নিশিখার মতো জ¦লে উঠবে / তারাই আমার কবিতা।’ (কবিতা)
কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ নানা দেশে ‘দেশের মিলিয়ন বিলিয়ন টাকা আজ বিদেশে বেড়াতে যাচ্ছে’ দীর্ঘকাল ধরে। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে কবির কাছে বিষয়টি ভালো লাগেনি; মেনে নিতে পারেননি এই অনাচার। এখানেই অন্য কবিদের মজিদ মাহমুদের পার্থক্য। অন্য কবিরা যেখানে পুলিশের বিধিমালা বা বাজারের ফর্দ লিখছে, শিয়ালের হুক্কাহুয়া লিখছে কারণ-
আজ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কবিতা লিখলে
সে দেশদ্রোহী হবে, কারণ রাজা চলে গেছে অন্য দেশে
এখন কেবল রয়েছে দেশ; দেশদ্রোহীর শাস্তি ভয়াবহ
(গিভআপ ইয়ুর হাঙ্গার স্টাইক)
অথচ কবি সেই সময় দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছেন দ্রোহের শব্দপুঞ্জ। কবির এই দ্রোহ কোনো ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়। যে দ্রোহের নেই নোমানল্যান্ড বা কাঁটাতারের জাল। যুগেযুগে কালেকালে দেশেদেশে মানবতা, সার্বভৌমত্ব যখন ক্ষুন্ন হয়েছে তখন কোন না কোন কবি দ্রোহের ধূমকেতু হয়ে আর্বিভাব হয়েছে। মানুষের পিঠ যখন দেওয়ালে ঠেকে যায়, পুত্রযখন ঘরে ফিরে না, বোন যখন ধর্ষিত হয়- এরপরও মনে হয় কারো যেন কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু কবি মজিদ মাহমুদ নীরব থাকতে পারেনি। দেশের প্রধানকেও আজ কিছু বলা কঠিন। তার সৈনিকেরা ক্রুব্ধ হয়। তাই কবি তার না বলা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন কবিতায়-
আমি তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে চাইনি
আমার যে পুত্র রাতের ঘরে ফেরেনি
যে কন্যা ধর্ষণের অপমানে উদ্বন্বনে মরেছে
আমিতো রাজ পথে ফেসবুকে খবরের কাগজে
এই জন্য বলতে চাই-
(কিভাবে বলব)
পাল রাজাদের থেকে শুরু করে পাকিস্থানী আমল পর্যন্ত রাজারা সবসময় ছিল রাজার দলে। রাজার পরিবর্তন হলেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। জনগণ ছিল ক্রীতদাস-তুল্য। তাই আবুুুুুু জাফর ওবায়দুল্লাহকে লিখতে দেখি-‘আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি / তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল / কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।’ তাহলে কি কেবল রাজার খোলোশ পরিবর্তন হয়েছে? কবি লিখছেন-
সরকার আগের মতো লাঠিপেটা করে
আরামবাগে কিংবা জালিওয়ানওয়ালাবাগে হত্যা করে
ছাত্র মিছিলে গুলি চালায়
কিন্তু প্রতিবাদ করা যাবে না
(নিয়তি)
শোষণের বন্দিশালা থেকে এমনি এমনি মুক্তিলাভ হয় না। মুক্তির জন্য চাই একতা। কবি আহ্বান জানিয়েছেন ঘুমন্ত মানুষকে একতাবদ্ধহয়ে জেগে উঠার জন্য। কবির ভাষ্যে- ‘বলতে চাই- অসংখ্য পিপীলিকা / একটি বৃহত্তর কামানের চেয়ে বড় / জেগে ওঠো প্রবঞ্চিত প্রেমিকের দল, সম্ভম হারানো বোন।’ (আমার কবিতা)
এখনো যারা- ‘আমার চারপাশও নিয়েছে মেনে বধির মূক / সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে বিষ্মরণ ও নৈঃশব্দ্যে বাঁচা’ এই বাঁচার মধ্যে কবি কোন অর্থ খুঁেজ পাননি। একদিন- ‘রুটি ও মদ ফুরিয়ে যাবে / তখন আর লেজের বাতাস দিয়ে মাছি তাড়ানোর / কি কোনো অর্থ আছে ! (কবির বিষয়)
গতানুগতিক কাব্যচর্চার বিরুদ্ধে কবির দ্রোহ পরিষ্কার। যে কবি নারী অঙ্গের উপমা দিয়ে কবিতা লিখে শুনাম কিনছে অথচ সেই কবির কলম নারীর ধর্ষণ বা হত্যাকা-ে ঠুটোজগনাথ হয়ে আটকে থাকছে। তাই সেই সব কবিদের কটাক্ষ করে কবি লিখছেনÑ ‘যে সব কবি তনুজাকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারে না / তাদের কবিতায় প্রতিটি শব্দের আরেকটি মানে / বিকৃত কাম, ধর্ষণ ও নারী হত্যা’ (তনুজা)
রাজা যায় রাজা আসে। মানুষ রাজাকে নয় রাজার কর্মকে মনে রাখে। যে কোন শিল্পীও বেঁচে থাকে তার কর্মের ভেতরে। বর্তনাম সমাজ ব্যবস্থায় নিজের আসনকে টিকিয়ে রাখতে কেউ হত্যার পথ বেছে নিচ্ছে না তো? কেউ যখন অন্ধকারে হাবুডুবু খায় তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিৎ তাকে আলোর পথে ফেরানো। বিচারকের রায়ে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে না তো? কবি মজিদ মাহমুদ লিখছেন-
‘জঙ্গি সে তো অন্ধকার রাজাদের সৈনিক
আর ক্রসফায়ার- অন্ধ বিচারকের রায়
………………………………………
তাদের রাজ্য নাই আইন ও আদালত নাই
মানুষের মৃত্যু তাদের অমরতার পথ’
(ক্রসফায়ার)
কবি দেখেছেন, দেশে দেশে জাতীয় জীবনের নেতৃত্বে সংকট। জনগণের মধ্য থেকেই এইসব দেশপ্রেমিক নেতার আর্বিভাব ঘটেছে। নেতা তৈরি হয় নিজ জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে। সব রাষ্ট্রই স্বাধীনতা, বিপ্লব ও যুদ্ধকালে যে ধরনের মেধাবী, যোগ্য ও আত্মউৎসর্গকৃত নেতৃত্ব পেয়েছিল পরর্বতীসময়ে সেই মান ও যোগ্য নেতৃত্বের ধারবাহিকতা সব সময়ে, সব রাষ্ট্রে অক্ষুন্ন থাকেনি। স্বাধীন রাষ্ট্রর্পবের বিকাশকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্বের সংকট ও অভাব প্রায় সব দেশেই কমবেশি ঘটেছে। যারাই রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘাড়ে চেপে বসে তাদের থাকে না কোন পতাকা, থাকে না কোন মানবতা। তারা সবসময় তাদের অঙ্গ সংগঠনের চিহ্ন বহন করে বেড়ায়। সব শোষকের রঙ এক। একপক্ষ অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে লেগেই থাকে নিরন্তর। তাদের- ‘বক্তব্য যাই হোক বাঁধা পুঁজিতন্ত্রে / বড়জোর সীমিত গণতন্ত্রে’ (কবি ও অঙ্গ সংগঠন)
আমরা দেখি ‘কাটাপড়া মানুষ’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ধ্বনিত হয়েছে কবির দ্রোহ। কখনো সমাজ, কখনো রাষ্ট্র কখনো আটপৌরে কাব্যসাধনার বিরুদ্ধে ‘কাটাপড়া মানুষ’ এর কবিতা দ্রোহের লেলিহান শিখায় সমুজ্জ¦ল হয়ে উঠেছে। মানবতাবাদী কবির এই মানবিক বয়ান ও বিন্যাস বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে বাস্তবিকই বিরল।
লেখক : এমফিল গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ॥