একাডেমিক লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি: উন্মেষ ও অভিযাত্রা প্রসঙ্গ

Dainik Pabna

লোকসাহিত্য

একাডেমিক লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি: উন্মেষ ও অভিযাত্রা প্রসঙ্গ

বঙ্গ রাখাল

এক
লোকসাহিত্যের প্রত্যেকটি শাখায় আমাদের সমাজে বিদ্যমান। যা বর্তমানে তার আলোকজ্জ্বলতা হারাতে বসেছে। এই লোকসাহিত্য চর্চা একাডেমিকভাবে সম্প্রসারিত হয় বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। ১৯২৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছরের জন্য দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯ কে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্য দীনেশচন্দ্র সেনÑ আশুতোষ চৌধুরী, চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬)কে সংগ্রাহক হিসেবে নিয়োগ দেন। এর সাথে যুক্ত করেন কবি জসীম উদ্দিন, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য ও বসন্ত রঞ্জক রায়ের মত নিষ্ঠাবান সংগ্রাহকদের। তবে পরবর্তীকালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর চর্চার আদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এই চর্চা শুরু করতে চেয়েছিলেন। তিনি সংগ্রাহক হিসেবেও কয়েকজনকে নিয়োগ দেন। ড. শহীদুল্লাহ লোকসাহিত্য সংগ্রহ সমিতিও গঠন করেছিলেন। তিনি ছিলেন সমিতির সভাপতি ও আশুতোষ ভট্টাচার্য ছিলেন সম্পাদক। এই লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গাতে ভিন্ন ভিন্ন কমিটি গঠিক হয়। যেমন ‘১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রমেশ শীলকে সভাপতি ও ফণী বড়ুয়াকে সম্পাদক করে ‘চট্টগ্রাম কবি সমিতি’ নামে গঠিত কবিয়ালদের সংগঠনই ছিল এই নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সহায়ক শক্তি। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রাউজানের বাগোয়ানে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা কৃষক সম্মেলনের ম-পে রমেশ শীলের নেতৃত্বে চাষি ও মজুতদার শীর্ষক এক কবির লড়াই হয়েছিল। সম্ভবত এই সম্মেলনেই নতুন যুগের নতুন রীতির কবিগানের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। (লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির সেকাল একাল- জামাল উদ্দিন)। তবে ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে চল্লিশ দশককে একাডেমিকভাবে লোকসাহিত্যের কাজের উন্মেষকাল বললেও ভুল বলা হয় না। এই সময়ই কেউ কেউ বেছে নেয় লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করার পথ। যেমন ড. আশরাফ সিদ্দিকী এই সময়ে পা বাড়ান লোকসাহিত্যের দিকে। তবে একটু ফিরে দেখলে দেখা যায় যেÑ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এসিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন স্যার উইলিয়ম জোনসের। এর কাজ গুলোর মধ্যে পাঠাগার, জাদুঘর, গবেষণা পত্রিকা ও আঞ্চলিক পুথি, মুদ্রা, চিত্র ও প্রাণিবিদ্যার নিদর্শন সংগ্রহ করা।

এই সময়ের নানা আন্দোলন সংগ্রামের বর্ণনাও পাওয়া যায় সেই সময়ের লোক কবিদের ছড়া, কবিতা বা পুঁথিতে। যা আমাদের সামাজিক অবস্থানকেই উপস্থাপন করে থাকে। ২ শে মার্চ ১৯৪৯ সালে কৃষক-প্রজা বিদ্রোহের শেষভাগে পুলিশের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ব্রিটিশ বিরোধি বিপ্লবী রবিদাম ধর্মপাশার মহেশখলার মোহনপুর গ্রামের এক হাজংয়ের প্রতারণায় শহীদ হন এবং সহযোগী প্রমোদ তালুকদার আহত অবস্থায় বন্দী হন। একটি লোকছড়ায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়Ñ সিচনির রবি দাম ঘরে থাইক্য না/ হাতে লও কাচি/স্বদেশি ফিরিঙ্গিদের কান কাইট্যা/চল বাজারেতে বেচি। (সুনামগজ্ঞের লোকসংস্কৃতি কৃষি ও কৃষক সমাজ : মোহাম্মদ সুবাস উদ্দিন।)

হাটে হাটে কিংবা বটবৃক্ষের তলে বসে মজমা জমাতেন কবিতা পড়ে। তাদের জীবন ছিল সংগ্রামমুখর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোককবিদের সৃজন সাহিত্য পাঠে তা অনুধাবন করা যায়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি তাদের সাহিত্য অর্থাৎ ছড়া -কবিতা- গান আমাদের সমাজ বাস্তবতা বা জীবনাচারণের জীবন্ত দলিল।

দুই
এই কথা সত্য যে, লোকসাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা নাই। আমরা যে সাহিত্য শিখি বা শিখাই অথবা আমরা যে সাহিত্য সৃষ্টি করি বা করাই, তাহার সমস্তই ‘শিষ্ট সাহিত্য’: ইহা নাগরিক সৃষ্টি যদি নাও হয়, তবু ইহা নাগরিক সাহিত্য। কেননা ইহাতে নাগরালি থাকুক বা না থাকুক নাগরিয়ানা বা নগুরে ভাব যে বর্তমান, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই সাহিত্য ভদ্রলোকের দেশের বিশাল লোক সমাজের নহে। ভদ্রলোকদের মতো এই ‘শিষ্ট সাহিত্য’ যেমন নগন্য, তাঁহাদের মতো তাঁহাদের সাহিত্যও তেমন পোশাকী। দেশ জোড়া লোক সমাজ যে সাহিতের সঞ্জীবনা সুধা পান করিয়া আজও বাঁচিয়া আছে সে সাহিত্যের নাম ‘লোক সাহিত্য’।১ লোক সাহিত্য একক কোন মানুষের সৃষ্টি নয়। এটি সমাজের সামগ্রিক সৃষ্টি। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে এই লোকসাহিত্য ঘুরপাক খেতে খেতে বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যযুগের বিচিত্র সাহিত্যের সঙ্গে যে লোক সাহিত্যের প্রভাব বিদ্যমান তা সহজেই অনুমেয়। মধ্যযুগের কাহিনি কাব্য, প্রণয়োপাখ্যান, অনুবাদ সাহিত্যগুলো দেখলেই দেখতে পাই- কবিদের লোক জীবনের নানা উপকরণ সংগ্রহের কথা যা আমাদের লোক সাহিত্যেরই নানা উপকরণ। প্রত্যেক জাতির সাহিত্যে দুইটি ধারা প্রবাহমান। ১. মৌখিক ও ২. লিখিত। চর্যাপদ থেকে সাম্প্রতিক কালের সাহিত্য সৃষ্টি হলেও লোকসাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করার মতো। প্রাচীন বলি বা মধ্যযুগের সাহিত্য যায় বলি না কেন তা লিখিত থাকলেও তা লোক সাহিত্যের মতো মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে থাকতো। গ্রাম বাংলায় মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনার কথা সহজভাবে ফুটে উঠেছে। এ ধারাটির মধ্য দিয়ে যা আধুনিক যুগে লিখিত এবং সুধী সমাজে গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠেছে। শহুরে সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলে চোখে মেলে নর্তকী, গায়ক, বাদক। যার শহরে কোন অভাবে নেই। কিন্তু গ্রামের দিকে তাকালে শহরের মত মোড়কের আড়ালে নর্তকীর লাল চামড়া দেখা যায় না, এখানে দেখা মেলে প্রকৃতির হাতছানি, পক্ষ্যির গান, দোয়েলের শিষ, শালিকের জলকেলি, গ্রাম্য বাউলের গানের আসর এই বৈচিত্রময় আবাহ সর্বদা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বেদনা, বিরহ-প্রেম, আচার-আচরণ ইত্যাদি যে সাহিত্যে স্থান পাই তাই মূলত ‘লোকসাহিত্য’ বা ‘পল্লী সাহিত্য’। শিক্ষিত মানুষের সাহিত্য তাদের চেতনা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ফসল। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য মানুষের হাজার হাজার বছরের ফসল। যে বিষয়টা অতি প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। অনেকে ধারণা করেন কৃষি প্রধান দেশের সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজে লোকসাহিত্যের উদ্ভব। কিন্তু এ বিষয়েও অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তবে কৃষি প্রধান মানুষই যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকসাহিত্যের সৃষ্টি করেছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেয়। কৃষিকে আমি লোকসাহিত উদ্ভাবনের, প্রধান বিষয় বলছি কেননা, বাংলাদেশে ভূ-প্রকৃতি লোকসাহিত্যের অনুকূলে। কারণ এদেশের বিস্তৃত মাঠ, নদ-নদী আমাদের হৃদয়ে প্রেম, ভালোবাসার সৃষ্টি করে। এ প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ-উচ্ছ্বাস, নর-নারীর মনকে করে তোলে উদাসীন। আহমদ শরীফ লোক সাহিত্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- প্রাকৃত জনের মৌলিক রচনাকে বলে লোকসাহিত্য। ‘লোক’ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ঋড়ষশ বলেই মানি। ‘লোক’ এর বাঙলা অভিধান প্রাকৃতজন, অর্থ্যা’ যে মানুষ কোন কৃত্রিম উপায়ে শিক্ষা সংস্কৃতি অর্জন করেনি, জন্মসূত্রে যে প্রকৃতি ঘরোয়া পরিবেশে ও সামাজিক পরিবেশ থেকে ভাব ও চিন্তা কর্ম আচরণ অনুকরণ করেছে সেই ‘লোক’।২ লোকসাহিত্য আমাদের ঐতিহ্য। যা আমাদের আঞ্চলিক সীমানা কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এক অঞ্চলের জিনিস অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে দূর্বোধ্য বা অননুকরণীয় বলেই বিবেচিত হয়। আবার কিছু লোকসাহিত্যের বিষয় আছে যা অঞ্চলকেউ অতিক্রম করে সমস্ত অঞ্চলের হয়ে গেছে যা আমাদের আঞ্চলিক সম্পত্তি না হয়ে দেশীয় বা বাঙালিয়া জিনিস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আমরা দেখি যে, এই লোকসাহিত্যকে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন ভাবে শ্রেণিকরণ করেছেন। যা আমাদের ভিন্ন ভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিত্যনতুন ভাবনার জায়গা তৈরি করে দেয়। লোকসাহিত্যকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন: ১. রূপকথা ২. ছড়া ৩. লোকগীতি বা লোকসংগীত ৪. গীতিকা ৫. শিশু সাহিত্য ৬. নাথগীতিকা ৭. ময়মনসিংহ গীতিকা ৮.পূর্ববঙ্গীয় গীতিকা ৯. প্রবাদ-প্রবচন ১০. মেয়েলী গীত ১১. উপকথা ১২. ব্রতকথা ১৩. ধাঁ ধাঁ, ১৪. তন্ত্র-মন্ত্র।


এছাড়া বাঙালি সারি, জারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, বাউল, গাজীর গান, পালাগান, পুঁথি সাহিত্য লোকসাহিত্যের অন্তর্গত। শিবালয়-মঙ্গল কাব্য, ময়নামতি, গোপীচন্দ্রের গান, ব্রত-পার্বন, ছড়া যাত্রাপালা, বিচারগান, কবিগান, অস্টগান, কীর্তন, গম্ভীরা, বাউল গানে বাঙালি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। ফুল্ললা-খুল্লনা, মেনকা-উমা, কালু-লক্ষা, মহুয়া-মলুয়া, চন্দ্রধর-সনকা, বেহুলা-লক্ষিন্দর, মতো কাহিনী সৃষ্টি করেছে এদেশের বাঙালিরা। ময়মনসিংহের কবি দ্বিজ কানাই রচিত ‘মহুয়া’ পালাটি কলসি কাঁখে মহুয়া সনাতন বাংলার চিরন্তর রূপ। ‘মহুয়া’ পালায় ‘মহুয়া’ ও নদের চাঁদের প্রেমপূর্ণ সংলাপ- ‘কে বা তোমায় মাতা কন্যা কে বা তোমায় পিতা / এদেশে আসিবার আগে পূর্বে ছিলে কোথা” / অথবা, কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ি / তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি।’ এক ধরনের আখ্যানমূলক গানকে আমরা গীতিকা হিসেবে পরিচিত করিয়েছি। গীতিকাগুলো গান হিসেবে গাওয়ার জন্যই রচিত হয়েছে। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেই এসব গীতিকা গাওয়া হয়। এগীতিকায় সুরের চেয়ে কাহিনির প্রাধান্যই বেশি থাকে। বাংলাদেশের গীতিকা গুলোকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন-

১. নাথগীতিকা

২. ময়মনসিংহ গীতিকা এবং

৩. পূর্ববঙ্গীয় গীতিকা।


প্রবাদ প্রবচন : প্রবাদ বা প্রবচন আমাদের লোক সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধশালী শাখা। মানুষের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, কথা-বার্তা, আচার ব্যবহারের মধ্য দিয়েই তৈরি হয় প্রবাদ-প্রবচন। প্রবাদ সম্পর্কে প্রবাদ বিশেষজ্ঞ সুশীলকুমার দের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য- ‘প্রবাদ বাক্যের আদি ¯্রষ্টা ছিল সাধারণ মানুষ, যাহায় সাধারণ বুদ্ধির বহুদর্শিতা প্রথমে প্রবাদের উপকরণের পরে প্রবাদের সৃষ্টি ও প্রচলন করিয়াছিল। যাহা পিতার বচন ছিল, তাহা কালক্রমে পুত্রের সম্পত্তি হইল।৪ আবার শশিমোহন চক্রবর্তী বলেছেন- একের অভিজ্ঞতায়, ‘ইহার জন্ম বহুর ব্যবহারে ইহার জীবন।৫ আমরা আমাদের কথায় কথায় এসব প্রবাদগুলো ব্যবহার করে থাকি। যার মধ্যে আমাদের প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের পরিচয়ও পাওয়া যায়। প্রবাদ-প্রবচন বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন- সংবাদমূলক, উক্তি-প্রত্যুক্তি মূলক, রূপকাহিনী। নিম্নে বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচন দেওয়া হলো-


১. চুন খেয়ে গাল পুড়েছে
দই দেখে ভয় করে।
২. দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না।
৩. মা মরে বউ বিয়ালো
যে তিন সেই তিনই হলো।
৪. গাছে না উঠেই এক কান।
৫. হাতে হারিকেন পুন্দে বাঁশ।
৬. যার রান্ধা খাইনি সে বড় রান্ধনি
যার দেখিনি সে বড় সুন্দরি।
৭. ছিড়া কাতায় শুয়ে লক্ষ টাকার স্বপ্ন।
৮. টাকা থাকলি মানষির অভাব হয় না।
৯. এমনি ছেড়ি ভাতার পায় না
গইনার প্রন্নিৎ কান্দে।
১০. ঘুটো কুড়োনির ছেলে না কি ম-ল হয়েছে
হেঁটে খেতে পারে না সে
পালকি চেয়েছে।
১১. পরের আশা যে করে নিত্য বাসে সে সরে।
১২. মরণের কথা চরণে কয়।
১৩. ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডান।


প্রবাদ-প্রবচন এমন একটি বিষয় যার মধ্যে থাকে রহস্যের নানা জাল। রূপকতার মধ্য দিয়ে এটা বলে, কিন্তু বোঝায় অন্য কিছুকে। এক বলে কিন্তু অন্য কিছু বোঝায় এটাই এক ধরনের প্রবাদের বৈশিষ্ট্য। এ প্রবাদের মাধ্যমে হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রƒপ ইত্যাদিকে বুঝানো হয়। আবার ঝগড়া বিবাদের সময় একপক্ষ অন্য পক্ষকে ঝগড়াই নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রবাদের মাধ্যমে গালি দেয়। লোকসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি আলোচিত একটি শাখা। যা জনপ্রিয়তার দিক থেকে অন্য যে কোন লোক সাহিত্যের চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত। ড. আশরাফ সিদ্দিকী লোকসংগীত কে ৬ টি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-

১. আঞ্চলিক গান
২. ব্যবহারিক গান-বিবাহ গান
৩. হাসির গান
৪. কর্মসংগীত বা শ্রম সংগীত
৫. প্রেম সংগীত ৬. বারমাসী।


কিন্তু ড. এনামুল হক লোক সংগীতকে ১০টি ভাগে ভাগ করেছেন। তা নি¤œরূপ: ক. প্রেম সংগীত- ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বারমাসী। খ. নৃত্য সংগীত- ঝুমুর, ভাঁজোই, ঘাটু, লেটো। গ. সহেলা সংগীত- যাবতীয় মেয়েলী সংগীত। ঘ. শ্রম সংগীত- সারি, বাইচ, ছাদপেটা, কর্মপ্রেরণার হুঙ্কার, নায় হুঙ্কার। ঙ. কৃষি সংগীত- জাগ, কার্তিকা, পুষালি। চ. আনুষ্ঠানিক সংগীত-গম্ভীরা, গজল, ভাদুই। ছ. পটুয়া সংগীত- দেবপট, গাজীপট। জ. শোক সংগীত- জারি গান, কান্না গান। ঝ. ভক্তি সংগীত- শাস্ত্র সংগীত, সোনাপীর, মালিকপীর, বদরপীর, মাইজ ভা-ারী। ঞ. তত্ত্ব সংগীত- বাউল, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব। লোকসংগীতের যে এত ভাগ, এগুলোর বিস্তৃত আলোচনা ছাড়া কখনো বোঝা সম্ভব নয়। তাই বস্তুত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

ক.
ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়ারে
যেদিন গাড়িয়ার উজান যায়
নারীর মন মোর ঝইরা রয় রে॥
ওকি গাড়িয়াল ভাই
হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে।
খ.
মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে
আমি আর বাইতে পারলাম না।
গ.
যে জন প্রেমের ভাব জানে না
তার সাথে নাই লেনা দেনা
খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা
সেজন সোনা চেনে না।
ঘ.
বউ কথা কউ পাখি ডাকে
মিষ্টি মধুর সুরে।
ঙ.
ওকী ও কাজল ভ্রমরারে
কোনদিন আসিবেন বন্ধু
কয়া যাও কয়া যাওরে।

এগান গুলোর সাথে শহুরে বা অন্য গানের তুলনা হতে পারে না। এ পর্যন্ত যে গান গুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো বাংলার পল্লী সাহিত্যের প্রাচীন সম্পদ। এগুলো মানুষের চাওয়া পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, বিশেষ করে নারীর শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা, অনাদর, ক্ষোভ বা পল্লী বালার প্রেমিক অথবা স্বামীর জন্য কামনা-বাসনার আকুল আর্তিক প্রকাশ ঘটেছে এ গানে। লোক সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে ভাওয়াইয়া গান। যে নৌকা বায় সে নৌকা বাওয়াইয়া, যে হাল চাষ করে সে হাল বাওয়াইয়া, যে মোষ চরাই সে (মইষাল) সেও বাইয়া। কেউ নৌকা বায়, হাল বায়, বোঝা বায়, এ সব শ্রেণির শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট যন্ত্রণার কথাও সুরের যে বিরহ গাঁথা আমরা পাই তা বাওয়াইয়া। আর এ বাওয়াইয়া থেকেই ভ্ওায়াইয়া গানের উৎপত্তি হয়। নদীর তীরে যে সব জনপদ গড়ে উঠেছে সেই জনপদের খেটে খাওয়া, সাধারণ মানুষ, মাহুত, মইষাল, রাখাল, গাড়িয়াল, পথে প্রান্তরে গরুর গাড়ি হাঁকিয়া অথবা পায়ে হেঁটে, ধান, পাট, তামাক ক্ষেত্রে উদাসী প্রহরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে খালি গলায় যে গীত হয় তখন তাকে বাওয়াইয়া বলে। সে সব সহজ সরল মানুষের নিজস্ব ভাষাই রচিত ভাওয়াইয়া গান। সে সব গানে কত তত্ত্ব, কত মমত্ববোধ। ভাওয়াইয়া গানের সাথে নানারকম বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এসব বাদ্য যন্ত্রের মধ্যে ১. একতারা ২. করতাল ৩. ঢোল ৪. মন্দিরা ৫. বাঁশি ৬. মুখ বাঁশি ৭. আঁড় বাঁশি ৮. সারিন্দা ৯. বমবাঁশি ১০. ঘুঙুর ১১. তবলা ইত্যাদি। কিছু প্রচলিত ও প্রাচীন ভাওয়াইয়া গান রয়েছে তা নিম্নরূপ-

আজি ধীরে বোলাও গাড়িরে গাড়িয়াল
আস্তে বোলাও গাড়ি
আর এক নজর দেখিয়া নেও মুঁই
দয়ার বাপের বাড়িরে
গাড়িয়াল আস্তে বোলাও গাড়ি
বাপ ছাড়িনু, মাও ছাড়িনু, ছাড়নু ঘর ও বাড়ি
অল্প বয়সেও ওমোর গাড়িয়াল
যাওদি শ্বশুর বাড়ি।


এ গানটিতে আমরা দেখতে পাই যে, একজন বিরহিনী নারীর প্রেমিক স্বামীর অপেক্ষায় কাতর হৃদয়ের আর্তনাথ। তারা স্বামীর গরুর গাড়িতে চড়ে স্বামীর বাড়িতে যায়। তাদের গানে বর্ণিত হয় নর-নারীর প্রেম-ভালোবাসা, বিচ্ছেদ-ব্যথা ইত্যাদি। আজ মানুষ লোকসাহিত্যের অনেক উন্নতি করেছে। তাদের রুমে আজ প্রবেশ করেছে লোকসাহিত্যের সুপ্রদেয় বাতাস এবং তারা আজ আস্তে আস্তে লোক সাহিত্যের কদর বুঝতে সচেষ্ট হচ্ছে। ভাওয়াইয়া গানকে মানুষের সামনে সুন্দর ভাবে পরিচিত করে তুলেছেন মরহুম আব্বাস উদ্দীন। দেশবরেণ্য কালজয়ী শিল্পী ভাওয়াইয়া স¤্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমেদ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দরদী কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ভাওয়াইয়া গান। বলা বাহল্য, তিনিই প্রথম গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া অশিক্ষিত মানুষের মুখ থেকে তুলে এনে আমাদের লোকজ সংস্কৃতিকে ভা-ারকে সবার সম্মুখে পরিচিত করে তোলেন। বাংলা সংস্কৃতির আরেক উপকরণ ঢাক-ঢোল। আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের আরও এক উপকরণ লাঠি খেলা। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে লাঠির খেলা করা হয়। আমাদের গ্রাম অঞ্চলে অতি প্রাচীন কাল থেকেই লাঠিখেলাই সমৃদ্ধ। অতি প্রাচীন কাল থেকেই লাঠিয়ালরা লাঠি খেলার মাধ্যমে মানুষের আনন্দ দিতে সক্ষম হয়ে আসছে। লোকজ সংস্কৃতির অন্য একটি ধারা কবিগান। এ গানটি অতি প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। উপস্থিত ক্ষেত্রে কোন কিছু নির্বাচন করে সেটা সম্পর্কে প্রতিযোগিতাই অংশ নেওয়াকে কবিগান বলে। কবিরা এ কবিতার চর্চা করে আসছে অতি প্রাচীন কাল থেকে। এরা জ্ঞান ভা-ারের সব বিষয়ে পারদর্শি। অনেকে মনে করেন গ্রামের কবিরা কিছু জানে না বা তারা তাদের কবিতাই কোন ছন্দ, তাল, লয় মেন্দে না চলে। এটা সম্পূর্ণ ভুল। তারা নিয়ম নীতি মেনেই তাদের কাব্য কবিতা রচনা করে থাকেন। অতি প্রাচীন কাল থেকে এ কবিগান গ্রামের মানুষের হৃদয়ে আনন্দ জাগিয়ে আসছে কেননা এ গান এখনও মানুষের হৃদয়ে খোরাক জোগাচ্ছে। আজও গ্রাম গঞ্জে কবি গানের আসর বসে। কবি গানের কোন বিষয় নির্ধারিত থাকে না। আসরে এসে একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে তারা যুক্তি তর্ক শুরু করে। কবি গানের মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তাশীলতার


বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শহুরে কবিরা গ্রামের কবিদের অবহেলা করে এবং গ্রামের কবিদের নানা ভাবে ঈর্ষার চোখে দেখে। তাদের বর্বর কবি বলে ভাবে। কিন্তু না, গ্রামের কবিরাও কাব্য জ্ঞান রাখে তারা শুধু কাব্য জ্ঞানই রাখে না, সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য ইত্যাদি সম্পর্কে নানাবিধ জ্ঞান রাখে। তারা গানের আসরের মাধ্যমে তাদের জ্ঞান গরিমা মানুষের সামনে তুলে ধরে। গ্রাম অঞ্চলে প্রতি রাতে কবিগানের আসর বসে। কবিগানের দিক থেকে আজও বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী। এ কবিগান যারা পরিচালনা করেন তাদেরকে কবি বা কবিয়াল বা সরকার বলা হয়ে থাকে। এদের লিখিত কোন দলিল নেয়। তারা মৌখিকভাবে উপস্থিত হয়ে কবিতা তৈরি করে থাকে। প্রাচীন কালে যখন মানুষের আনন্দের জন্য কোন কিছু ছিল না ঠিক তখনই মানুষ কবিগানকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকতো এ গান। কখনও লিখিত হয়নি বা কেউ লেখার চেষ্টাও করেনি। এটা প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মুখে মুখেই চলে আসছে। তৎকালীন সমাজে বা সনাতন সমাজে মানুষ আনন্দ উপভোগের সময় কবিগানের আসর বসাতো। কবিগান ১৮৫৪ সালে সর্বপ্রথম কবি ঈশ্বর গুপ্ত সংগ্রহ করে। এভাবেই সংবাদ প্রভাবকের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কবিগান সম্পর্কে মানুষ পরিচিতি লাভ করে। এগানকে প্রাচীনকালে বৈঠকী গান বলা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে এটা কবিগান নামে পরিচিতি পায়। সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, আগের মানুষেরা সামাজিক উৎসবে নিজেদের আনন্দের জন্য কবিগানের আসর বসাতো। এ কবিগানকে কেউ কখনও মর্যাদা দেয় নি বা সাহিত্যের সম্মানও দেয় নি। কিন্তু কবিগান হলো আমাদের প্রাচীন সাহিত্য। এ সাহিত্যকে আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না। কবিগান সর্বপ্রথম যারা প্রচলন করেন তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন নিম্নে বংশে। শুধু নিম্ন বংশের নয় কিছু কিছু উচ্চ বংশেরও ছিল। তবে নি¤œ বংশের মানুষের সংখ্যায় বেশি। কবিগান প্রাচীন কালে অনেক প্রকার ছিল রাধা-কৃষ্ণের বিষয়ক কবিগান, এছাড়া ছিল সখী সংবাদ, বিরহ খেউড় ইত্যাদি। এ কবিগানে রাধা-কৃষ্ণের জীবন লীলা বর্ণিত হয়ে থাকে। পল্লী সাহিত্যের মধ্যে কবিগান নিহিত। কবিগাণকে অবহেলা করলে পল্লী সাহিত্যে তথা বাংলা বিশাল সাহিত্য ভা-ার থেকে হারিয়ে যাবে। লোকসাহিত্য বা পল্লীসাহিত্যের আরেকটা জিনিস হলো জারি ও সারি। এটিও অতি প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহারিত হয়ে আসছে। জারি হলো মহরমের ঘটনাকে আশ্রয় করে গীত হয় বা এটার মাধ্যমে মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বিলাপ গীত হয়। আর সারি হলো শ্রম-জীবী মানুষের গীত। নৌকা বাইচের সময় সারিগান গীত হয় আমাদের দেশে প্রতি বছর নৌকা বাইচ হয় এ নৌকা বাইচের সময় সারি গান গীত হয়। পল্লী সাহিত্যের আরেকটা বিষয় হলো বাউল গান এবং যাত্রা পালা। অতি প্রাচীন কাল থেকে মানুষ একতারা হাতে পথে ঘাটে, নদীর চরে এক ধরনের গান গেয়ে বেড়াতো এসব মানুষকে বাউল বলা হয়। বাউলরা তাদের মনের দুঃখ, ব্যথা, বেদনা ইত্যাদি তার গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে। বাউল শব্দ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন বাতুল থেকে বাউল শব্দটি তৈরি হয়েছে। যার অর্থ পাগল। এ বাউলেরা সংসার সম্পর্কে উদাসিন। বাউলের আর একটা অর্থ আছে সহজ সরল। তারা খুব সাদা-সীদা জীবন যাপন করে। লৌকিক বাংলার সমাজ সংস্কৃতি ধর্মে বাউল একটি বড় স্থান দখল করে আছে । বাউলের সাধনা ও সঙ্গীতে বহুকাল ধরে বাঙ্গালির মানস জগৎকে উন্নতি করে আসছে। বাঙ্গালি লৌকজ-ধর্মে বাউলের মত ও সাধনা অতি প্রাচীন কাল থেকে বয়ে আসছে। বাউল গান বাংলার প্রধান লৌকজ সংস্কৃতির বিশাল স্থান দখল করে আছে । এ বাউল গানের মধ্যই মানুষের অধ্যাত্মিকবাদ, সামাজিকতা, ধর্ম, সংসার, নারী ইত্যাদি-সম্পর্কে নানাবিধ তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। কিছু বাউল গান নিম্নরূপ-


ক.
‘সাঁই আমার কখন খেলে কোন খেলা
জীবের কী সাধ্য আছে তাই বলা
কখনও ধরে আকার, কখনও ধরে নিরাকার
কেউ বলে আকার; কেউ নিরাকার
অপার ভেবে হই ঘোলা।’
খ.
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন বেঁড়ি
দিতাম পাখির পাই।”
গ.
‘মানুষ ভোজলে সোনার মানুষ হওয়া যায়’
ঘ. ‘আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে’
ঙ. ‘শুধু কাথায় রতন কি মিলে ।।
চেতন মানুষেরই সঙ্গ না নিলে”
চ. “শতরঙের দেখিরে গাভী
একই রঙের দুধ গো দেখি
তবে কেন ত্রিজগতে মান বিচ করত্যাছি’।


বাউলদের নানাবিধ গান বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাদের গান বাংলার সাহিত্য ভা-ারকে ধনী করে তুলেছে। বাউল গান আজ বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারার লোকপ্রিয় শিল্প নিদর্শনের মর্যাদা পেয়েছে। আজ লোকজ সাহিত্যের সংস্পর্শে মানুষ নিজের জীবনকে আলোকিত করেছে। বাউলগণ আজ সুধী সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাউল গানের সবচেয়ে বড় কথা জীবন কিছু নয়, এগুলো হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধন এ বন্ধন থেকে তারা মুক্ত হতে চাই। তাই তারা এ বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিবাহ করে না (কেউ কেউ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়) কিন্তু তারা রমনী গ্রহণ করে। এটাকে তারা তাদের সাধনার একটা অংশ বলে মনে করে। অতি প্রাচীন কালে আমাদের দেশে সহজিয়া নামে এক ধরনের সাধনা তন্ত্র ছিল। এ সহজিয়ার মাধ্যমে তারা আনন্দ লাভ করতো। তাদের মধ্যে নারী পুরষে কোন প্রকার ভেদাভেদ ছিল না। তাদের চোখে সবাই সমান ছিল। সবাই মানুষ এবোধই তাদের মধ্যে বড় হয়ে দেখা দিত। নিজেকে চিনতে পারলে অন্যকে চেনা যায় তাই প্রথম নিজেকে চিনতে হবে। কারণ নিজের দেহ মন্দিরে ঠাকুর বা মন মসজিদের ইমামকে যদি খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সবকিছু খুজে পাওয়া যায়। তাই লালন বলেন:-


আমার এ ঘর খানায় কে বিরাজ করে
তারে জনমভর একবার দেখলাম নারে
নড়ে চড়ে ঈশান কোণে
দেখতে পায়নে এই নয়নে
আপন ঘরের খবর হয় না, বাঞ্ছা করি
পরকে চেনা। বাউলের সাধনা দেহ কেন্দ্রিক।

বাউল গানে এই দেহকে কখনও ঘর, মন্দির, মসজিদ, আরশিনগর, জাহাজ, নৌকা ইত্যাদি নামে বাউলেরা অভিহিত করে থাকে। বাউলদের সবকাজ দেহকেন্দ্রিক। তাদের জীবনে বিবাহের বন্ধন নেয়, মা-বাবার বন্ধন নেয়; ঘর বাড়ি বা সংসারের সন্ধান নেয়। তারা সবকিছু সম্পর্কে উদাসিন। তারা বংশের বন্ধন মুক্ত, তাইতো তাদেরকে সাধু বলে অভিহিত করা হয়। বাউলদের বিশাল কাজ সঙ্গীতের বহিঃপ্রকাশ। সঙ্গীতকে আশ্রয় করেই তারা বেঁচে থাকে। তাদের একমাত্র সাধনা, জ্ঞান হলো তাদের সঙ্গীত। সঙ্গীতই তাদের ঘর, সংসার, ধ্যান। বাউলদের কাছে জাত বিজাতের কোন মূল্য নেয়। তাদের কাছে সব ধর্ম, বর্ণ, জাত-বেজাত, উঁচু-নিচু সবাই সমান। তাইতো বাউল সাধক লালন বলেছেন:-


‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতের কী রূপ, দেখলাম না এ নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলাম
নারী লোকে কি হয় বিধান?
বামন যিনি পৈতায় প্রমাণ
বামনী চিনি কি ধরে।
কেউ মালা, কেউ তসবি গলায়
তাইতে কী জাত ভিন্ন বলায়।’

লালন জাতি, বর্ণের প্রশ্ন বেশি করেন নি। তিনি মানুষের শৃঙ্খলা জীবনের চেয়ে স্বাধীন জীবনের বর্ণনা বেশি করেছেন। তিনি জয় গান করেছেন- মানবতা বোধের, মানব হৃদয়ের। তাই তো তিনি শ্রেষ্ঠ সর্বকালের সর্বমানবতা বোধের। বাউলেরা অধ্যাত্মবাদী, কিন্তু এই অধ্যাত্মবাদ দেহত্মবাদকে অবলম্বন করে বাদ দিয়ে নয়। বাউলেরা একতারা হাতে গান করে বেড়ান। বাউল গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাউল হল লালন সাঁই, গগণ হরকরা, পাঞ্জুশাহ, পাগলা কানাই, শীতলাং শাহ্, শেখ ভানু, শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপা, মনসুর বয়াতি, ভবা পাগলা, মহিন শাহ্, কালু শাহ্, গোঁসাই গোপাল প্রমুখ। তবে বাউল গানকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছেন লালন। বাউল গানের নানা পরিচয় পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের নানাবিধ রচনায়। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানে প্রভাবিত হয়েই তো শেষের দিকে সন্ধান করে চলেছিলেন জীবনদেবতার। আমাদের যশোর-ঝনাইদহ-কুষ্টিয়া লালন সঙ্গীত বা বাউল সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। এ অঞ্চলকে বলা হয় বাউলের জন্মস্থান। একে অতিক্রম করার মতো অদ্বিতীয় কোন বাউল সঙ্গীতের সন্ধান আজও কোথায়ও মেলেনি। তাই এই বাউল সঙ্গীতকে টিকিয়ে রাখার জন্য বা এর ভাবধারা মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য সুধী সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। লোকজ ঐতিহ্যের অন্য ধারা যাত্রা। এ যাত্রাও প্রাচীন লোকজ ঐতিহ্যের শক্তিশালী ধারা। এটার মধ্য দিয়ে মানুষের দুঃখ, কষ্ট, ভালবাসা, প্রেম-প্রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বাহি ধারা যাত্রা। যাত্রা এক ধরনের নাটকীয় বিনোদন হলেও যাত্রা কোন নাটক নয়। কিন্তু নাটকের একটা নিজস্ব ধারা আছে যা যাত্রার মধ্যে নেয়। বিভিন্ন জায়গা একই যাত্রা অভিনিত হতে পারে। কবি গান যেমন বাইনা করে আসর বসানো হয় ঠিক যাত্রা পালাও তেমনই করে বাইনা করা হয়। আগের দিনে মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য গ্রাম্য এলাকায় যাত্রাপালা হয়ে থাকতো। কিন্তু আজ যাত্রা পালার সেই আসর খুব একটা সামনে দেখা যায় না। কিন্তু বর্তমানে যাত্রার কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন মানুষের জীবন অবলম্বনেও রচিত হয়েছে বিভিন্ন যাত্রাপালা। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও রচিত হয়েছে একাধিক যাত্রা। আজ দিন বদলের পালায় নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে যাত্রা শিল্পে। আমরা যদি আমাদের পূর্ববর্তীদের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখবো যে, সে সময় যাত্রার অভিনয় শিল্পিরা সবাই পুরুষ ছিল। তারা সাজ-সজ্জার মাধ্যমে মহিলা সাজ গ্রহণ করতো। কিন্তু বর্তমানে তার কিছুটা দিক পরিবর্তন হয়েছে। এখানে নারী পুরুষ উভয়ই অভিনয় করছে। তেমনই একটা যাত্রা ‘কমলার বনবাস’। কমলা তরবারি হাতে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে অবাক। প্রাণের স্বামী আমার, তুমি বাণিজ্য থেকে আসলে কীভাবে। কমলা জানতে চাই। কমলা আমি স্বপ্নে দেখেছি, যে নারী আজ গর্ভবতী হবে তার একটি পুত্র সন্তান হবে। তাই আমি উপায়ান্তর না দেখে দরবেশ বাবাকে বললাম তোমার কাছে পৌঁছে দিতে। সেই তোমার কাছে আমায় পৌঁছে দিছে। আর দেরি করো না কমলা… আমার কাছে এসো, আমার বুকে এসো, তোমাকে আমার বুকে পেতে খুব ইচ্ছা করছে। সকাল হবার আগেই আবার জামাল চলে গেল। তারপর…। সকাল হলো। জানাজানি হলো, কমলা কোন এক পুরুষের সাথে রাত যাপন করেছে। কেউ বিশ্বাস করল না, রাতে তার স্বামী এসেছিল। সবাই তার নামে কলংক দিল। এসব কথা জানার পরে কমলার শ্বাশুড়ি তাকে বনবাসে পাঠাল। এই ছিল কমলা বনবাসের দৃশ্য। যাত্রা উপলক্ষ্যে এক এক অঞ্চলে বসে বিশাল মেলা। এ মেলাই প্রভাবশালী লোকেরা এসে জুয়া খেলা করে এবং অশ্লীল নৃত্যই যাত্রার ভবিষ্যৎ বলে অনেকে মনে করে। এসব কারণে যাত্রার কথা শুনলে অনেকে নাক সিটকায়। আবার অনেকে যাত্রা সম্পর্কে তার বাক্য ছুড়ে মারে ‘যাত্রা দেখে যাত্রা লোকে’। তাই এটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে অশ্লীলতা বাদ দিয়ে এটার মধ্যে শ্লীলতা আনতে হবে। যাত্রা পালাকে বলা হয় বাংলা সংস্কৃতির ধারক।
চল্লিশের দশকের গ্রামীণ মানুষের মধ্যে লোকোৎসব, কবিগান, ছড়া, যাত্রাপালা, কীর্তন, গাজিরগান, সার্কাস, লোকনাট্য, লোককবিতের সৃষ্ট নাটক, ছড়া-কবিতা সৃষ্টি হয়েছ প্রচুরÑযা আমাদের কাছে আজ অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
এই যে অমূল্য সম্পদ আমাদের এই সম্পদের সঠিক ব্যবহার বা এর মূল্য না জানার ফলে মহামূল্যবান এই সম্পদ কালের গহ্বরে হারিয়েও গেছে। লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লোকক্রীড়াও এই সময় আমাদের মধ্যে প্রগাঢ়ভাবে বিদ্যমান ছিল। প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে বাবা দাদার মুখে শুনেছিলাম দাদাজান যাত্রাপালা, কবিগান, অষ্টগানের আসরগুলোতে অনায়াসে যাতায়াত করতেন। এই সময় মানুষের মধ্যে একধরনের একত্বতাবোধ বিরাজমান ছিল যা বর্তমানে ক্ষীণ। আমাদের সমাজের সবই এই ফোকলোরের অন্তভুর্ক্তÑকোন ভাবেই লোকসাহিত্যকে জীবন থেকে অস্বীকার করার অবকাশ নেই। কারণ লোকসাহিত্যকে অস্বীকার মানে তো নিজের জীবনকে অস্বীকার করার নামান্তর।

SHARES

ফেসবুকে অনুসরণ করুন

আরো পোস্টঃ