আহমদ ছফা : এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর

Dainik Pabna

আহমদ ছফা

আহমদ ছফা : এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ

এক

এক সুগভীর বেদনা নিয়ে আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) তার সাহিত্যকর্মে এসেছিলেন। এই বেদনা ছিল তার জীবনের প্রতি, তার প্রতিবেশির প্রতি, তার স্বজাতি ও স্বগোষ্ঠীর প্রতি-যারা প্রতিদিন, প্রতি পদে, প্রতি মুহূর্তে, নিপীড়িত হয়, নির্যাতিত হয়; বেনোজলের মতো যাদের জীবন অন্তহীন দুঃখের সাগরে ভেসে যায়; যাদের পায়ের নিচের মাটি সমুদ্রসৈকতের বালির মতো আস্তে আস্তে সরে যায়, যারা এতোটুকু দাঁড়ানোর মতো ঠাঁই পায় না; যাদের দুকূল অথৈই জলের মতো থইথই করেÑএই সব সহায়হীন, এইসব সম্বলহীন মানুষ ও মানবাত্মার জন্য মহাত্মা আহমদ ছফার লেখকপ্রাণ ছটফট করে কেঁদে ওঠে। নিজেকেও আহমদ ছফা ঐ ক্রন্দনরত জনজীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বিবেচনা করেন। তাই তার লেখায় এতো মানববিক সুর ও স্বরের ঝংকার ঝলক দিয়ে ওঠে। আহমদ ছফার প্রথম প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ‘সূর্য তুমি সাথী’ (১৯৬৭), ‘দোলো আমার আমার কনকচাঁপা’ (১৯৬৭), কিংবা ‘নিহত নক্ষত্র’ (১৯৬৯) এইসব গ্রন্থাবলির বিষয়বিন্যাস ও উপস্থানাশৈলীর অন্তরালে ঐ মানবিক চিন্তাচেতনার প্রবল পরিক্রমা লক্ষ্য করা যায়। এই গ্রন্থ কয়টি পূর্ব পাকিস্তান আমলে রচিত ও প্রকাশিত। এইসব গ্রন্থে আহমদ ছফার লেখাকে একটি নদীর সাথে তুলনা করা চলে যার দারুণ গতিবেগ আছে, চলার ছন্দ আছে, আছে বয়ে চলার দুঃখ ও দুর্দশা। এই পর্যন্ত আহমদ ছফার বেদনা ছিল কিছুটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কিছুটা শ্রেণি কেন্দ্রিক।

দুই

মহান মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) আহমদ ছফার জীবন ও সাহিত্যে একটি টার্নিং পয়েন্ট। আহমদ ছফার সাহিত্যচিন্তা আর ব্যক্তি কেন্দ্রিক রইল না; শ্রেণিকেন্দ্রিক রইল না। তার লেখালেখি সেই মৃদুমন্দ নদীর দুকূল ছাপিয়ে সাগরে রুপান্তরিত হয়ে গেল যেখানে বঙ্গপোসাগরের মতো উথালপাতাল ঢেউ আছড়ে পড়ে। ব্যক্তি থেকে, শ্রেণি থেকে জাতিসত্তায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রবল আবেগ ও আকাক্ষা তার সাহিত্যচিন্তায় টগবগিয়ে ফুটে উঠতে থাকে। ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ (১৯৭১) তার অনন্য প্রমাণ। গ্রন্থটি আহমদ ছফা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় বসে গায়ে টাইফয়েড জ্বর দিয়ে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সম্পন্ন করেছিলেন এবং জুলাই মাসে গ্রন্থটি কলকাতা থেকে প্রকাশ হয়েছিল। এই গ্রন্থে আহমদ ছফা আশা পোষণ করেছিলেনÑমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই দেশে রেনেসাঁর শুভ সূত্রপাত ঘটবে। সাহিত্যে, সঙ্গীতে, শিল্পে, আবিষ্কারে-অন্বেষণে, আদর্শ ও উৎকর্ষে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এই দেশ বিশ্বদরবারে ঠাঁই করে নেবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যমৈত্রী, স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদায় দেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দুনীতি, লুটপাটসহ সেই পাল আমলের মাৎস্যন্যায় পরিবেশ দেখে তিনি হতাশ হোন; হতাশ হোন দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আমলাসহ শিক্ষিত ও সচেতন সমাজের স্বার্থপরতা দেখে। এই সময় আহমদ ছফা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭২) লিখে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় উঠে আসেন। এই গ্রন্থে মূলত বুদ্ধিজীবী সমাজের তীব্র সমালোচনায় তিনি নিজেও আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন।  

তিন

আহমদ ছফা তার সাধের রাষ্ট্র গঠনের জন্য একসময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গে যুক্ত হোন। এবং এই দলের মুখপাত্র দৈনিক গণকণ্ঠে প্রায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। কিন্তু সেই দলটিও সূক্ষ্ম সুবিধাবাদীতায় নানা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। আহমদ ছফার প্রত্যাশা ছিলÑএমন একজন নেতার যে ধুলাকাঁদা মাখা বাঙালি জাতির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পড়ন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলবে। সেই নেতার সাক্ষাৎ না পেয়ে বলা যায় মানসিকভাবে আহমদ ছফা অনেকটা ভেঙ্গে পড়েন। এই সময় তিনি লেখেন ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ (১৯৭৭)। আহমদ ছফা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নেন; আশ্রয় নেন তার সাহিত্য সাধনার কাছে। এসময় কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধসহ নানা বিষয়ে লেখালেখিতে তার বিপুল ব্যস্ততা। তার সাধের সমাজতন্ত্রের আকাক্সক্ষা যে অপূর্ণই রয়ে গেল ‘লেনিন ঘুমাবে এবার’ (১৯৯৯) গ্রন্থটি দ্বারা বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়। তাই বলে তিনি থেমে যাননি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত তিনি তার স্বদেশ ও স্বজাতির কাছ থেকে এতোটুকু সরে আসেননি। তার জীবন ও যৌবনের সবটুকু উজাড় করে দেশ ও জাতির কল্যাণে ঢেলে দিয়েছিলেন। ৩০ শে জুন এই মহান সাহিত্যিক প্রাচ্যদেশের পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম জেলার চন্দ্রনাইশ থানার অন্তর্গত গাছবাড়ীয়া গ্রামে জন্মেছিলেন। এমন সাহিত্যিকের জন্ম এই দেশে খুব বেশি হয়নি। কবি জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) মতো করে বলতে হয়Ñ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’।

সরকারি কলেজের শিক্ষক, গবেষক

SHARES

ফেসবুকে অনুসরণ করুন

আরো পোস্টঃ