আশরাফ খান এর গল্প অপমান

Dainik Pabna

অপমান

আশরাফ খান

চাকরি খুজতে খুজতে ক্লান্ত বিষন্ন এক দুপুরে ক্ষুধার জ্বালায় এতোটাই অস্থির হয়ে উঠি যে, কোনকিছু বাছবিচার না করেই চোখের সামনে দৃশ্যমান রেস্তোরাঁয় ডুকে পড়ি দুপুরের খাওয়ার জন্য, ক্ষুধার্ত বিড়াল যেমন খাবারের গন্ধ পেয়েই ঢুকে পড়ে ধনীর রান্নাঘরে। মাছির মতো মানুষের ভীড়ে ভিতরে ঢুকেই বুঝতে পারি এতো এতো কর্পোরেট মানুষের ভিড়ে আমি আসলেই ভুল করে কুকুর বেড়ালের মতো ঢুকে পড়েছি। আয়নার মতো চকচকে গ্লাস ভর্তি পানি দিয়ে যায় টেবিল বয়। সঙ্গে সঙ্গে ওয়েটার এসে জানতে চাইলো- ‘স্যার, কি খাবেন’। আমি বললাম- ‘ভাত আর ডিমের তরকারি’। ওয়েটার মুখ দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় আমার অর্ডারে সে সন্তুষ্ট না। মুহুর্তের মধ্যে স্যার থেকে ভাই সম্বোধন করে বলল- ‘ডিমের তরকারি দিতে দেরি হবে, ভাই’। তার কথাবার্তা ও ভাব দেখে মনে হলো সে বোঝাতে চাচ্ছে যে,- ‘ডিমের তরকারি দেরি হবে। মানে, আপনি চলে যেতে পারেন’। কিন্তু আমিও নিলর্জ্জ নাছোড়বান্দার মতো বললাম- ‘সমস্যা নাই। আপনি দেরি করেই দেন’। ওয়েটার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে চলে গেল।

লাঞ্চের উপযুক্ত সময় হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি অফিস স্টাফ, উকিল, মুহুরি এবং ব্যবসায়ীদের ভীড় পড়েছে। তাদের কেউ ভাগাইর মাছ, কেউ আইর মাছ, কেউ ব্যায়াম মাছ, কেউ বোয়াল মাছ, কেউ আবার রুই মাছ অথবা খাসির গোস্ত, গরুর গোস্ত, মুরগির গোস্তের সাথে ভর্তা, ভাজি এবং খাওয়া শেষে দই অথবা কোমল পানীয় পাণ করে মোটা অংকের বিল পরিশোধ করে ক্যাশ কাউন্টার পাশে রাখা নীল রঙ্গের চৈৗকোণা বোতল থেকে ধনিয়া সস ও চাল ভাজি মুখে চিবোতে চিবোতে আর টুথ পিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে চলে যাচ্ছে।

বড় বড় অর্ডারের ভিড়ে ডিমের তরকারি দিয়ে ভাতের অর্ডারটি ওয়েটার প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আমার পাশের জনকে বোয়াল মাছের ঝোল দিতে এসে তার মনে পড়ে এবং অনেকটা করুণাবশত এক প্লেট ভাত দিয়ে যায়। ভাত দেওয়ার আরো কিছুক্ষণ পর তরকারি নিয়ে আসে, আলু ঘন্টো দিয়ে ডিমের তরকারি। তরকারি দেওয়ার পর আমি ওয়েটারকে বললাম – ‘ভাই, একটু লেবু আর শশা দিয়েন’। আমার কথা শুনে হিং¯্র বাঘ যেমন শিকারির দিকে রাঙ্গা চোখে তাকায় ওয়েটার অনেকটা তেমনি ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বলে-‘এ্যা, ডিম দিয়া ভাত খাইবার আইসা আবার লেবু শশা চায়। ডিম ভাতের সাথে লেবু শশা হয় না’।

২.

কোন এক শীতের রাতে হাটতে হাটতে তালতলা বিকাল বাজারে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করে এমন একটা দোকানের সামনে দাড়াই। মফস্বল শহরের এই জনবহুল বাজারে সবজি এবং মাছের বাজার বিকালে বসে বলে লোকমুখে এটি বিকাল বাজার নামে পরিচিত। তালতলা বাজারে আট থেকে দশটি চাস্টল, সিদ্ধ ডিমের দোকান, পুড়ি সিঙ্গারার রেস্তোরাঁ, ফল বিপনী এবং তিন থেকে চারটি ঝালমুড়ি দোকান, মিষ্টান্ন ভান্ডার, কয়েকটি উন্নতমানের মুদিখানা, ঔষুধালয়, গোখাদ্যর দোকান, হার্ডওয়ার সামগ্রি বিক্রয়কেন্দ্র, কয়েকটি ওয়ার্কশপ এবং ‘ছ’ মিলে সবসময় কম বেশি ভীড় লক্ষ্য করা যায়। মাছের বাজারের বড় বড় ইলিশ, রুই, নদীর দামী দামী ছোট-বড় মাছ কোনটাই পড়ে থাকে না। নিমিষেই ফুরিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে মাঝারি গোছের ভাগাইর মাছও ওঠে এবং সেটাও বিক্রি হয়ে যায়। এখানে সপ্তাহে একদিন হাটও বসে। শতবর্ষী এই হাটটি একসময় বৃহত্তর পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় পশুর হাট হিসেবে পরিচিত ছিলো। এখন আগের মতো হাটের বাহার না থাকলেও একেবারে কমে যায় না। তালতলার লোকেরা বলে- ‘নদী মরে গেলেও তার র‌্যাক থেকে যায়’। তারা আরো বলে যে ‘ কুনো কুনো দিন হাটে পরী নে’মা আইসে। যেদিন হাটে পরী নে’মা আইসে সেদিন দুই চার মাইল দূর থেকে হাটের গমগম আওয়াজ শোনা যায়, আর হেদিন হাটের কোন সদাই পইড়া থাকে না, সব ফুইরা যায়’।

হাটতে হাটতে আমি যখন ডিমের দোকানের সামনে দাড়াই তখন দোকানী দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইতোপূর্বে অনেক সময় ওই দোকানে ক্রেতাগণকে লাইন ধরে সিদ্ধ ডিম কিনতে এবং দোকানের সামনে সাজানো ছোট ছোট টুলে বসে ছোট ছোট পিরিচে ডিম খেতে দেখেছি। এমনিভাবে অনেক রাত অবধি দোকানে ভীড় লক্ষ্য করা যায়। তবে সেদিন রাত বেশি না হলেও শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় বাজারে মানুষজনের উপস্থিতি কম ছিলো। মুরগি ও হাঁসের ডিমের পাশাপাশি কোয়েল পাখির ডিমও বিক্রি হয় ওই দোকানে। হালকা বাদামী রঙের খোসার উপর কালচে ছোপ ছোপ দাগের কোয়েল পাখির ছোট ছোট ডিমগুলো দেখতে আমার কাছে যেমন সুন্দর লাগে তেমনি খেতেও ভীষণ মজা লাগে। আমি ডিমওয়ালা জিজ্ঞেস করলাম
-ভাই, কোয়েল পাখির ডিম দেওয়া যাবে ?

  • যাবে।
  • দাম কত ?
  • বিশ টাকা হালি।
    দামটা আমার কাছে একটু বেশি মনে হলেও দোকানীকে বললাম – ‘এক হালি কোয়েল পাখির ডিম দিয়েন’। দোকানী ডিম হাতে নিতে নিতে আমার দিকে তাকিয়ে ডিমের সংখ্যা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলেন ‘ভাই, কয়টা’। আমি বললাম- ‘এক হালি’। এবার লোকটি হাত থেকে ডিম পাতিলে রেখে দিয়ে বলল- ‘হবে না’। আমি বললাম- ‘আপনি যে বললেন হবে’। লোকটি বলল- ‘ডিম আছে কিন্তু দিমুনা’। আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কেন দিবেন না’ ? দোকানি এবার বলল- ‘এক হালি ডিমের জন্য আহুন আর আতে (হাতের কথ্য রুপ) পানি বড়ামু না’। আমি বললাম- ডিম তো মানুষ একটা দুইটাই খাই। ডিম আবার কতগুলো খাবে’ ? এর উত্তরে দোকানির কথা শুনে আমি রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেলাম- ‘একটু আগে একজন ইহিনে বস থেইক্যা বারোটা দেশি মুরগির ডিম খাইয়া গেল। আর একজন আইসা পঞ্চাশটা নিইয়া গেল।’ আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘একজন মানুষ পঞ্চাশটা ডিম দিয়া কি করবো’। দোকানদার বলল- ‘শুধু আজকা না। উনি পরায় পরায় আইসা পঞ্চাশটা ক’রা ডিম নিয়া যায়। হেরা নাহি তিন চার জন রাতে তাস খেলে আর ডিম খায়’। আমি দোকানদারের দিকে একবার গভীরভাবে তাকালাম এবং তার মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা কথাটি বোঝার চেষ্টা করলাম, যে কথাটি সে আমাকে বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না – ‘তুমি মিয়া কামাই করাও জানো না খাওয়াও জানো না’।

SHARES

ফেসবুকে অনুসরণ করুন

আরো পোস্টঃ