একজন অচিন্ত্য চয়ন
আমিনুল ইসলাম
সদ্য অতীত হয়ে আসা ঘনঘন বদলির পথ ধরে হাঁটতে থাকা পেশাগত জীবনে অচিন্ত্য চয়নের সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত ২০০৪ সালে আমার প্রথমবারের মতো বগুড়া লেখক চক্র সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষ্যে। তখন সে বগুড়া লেখক চক্রের একজন উৎসাহী সক্রিয় কর্মী। তারপর থেকে প্রায় নিয়মিত যেতাম বগুড়া লেখক চক্র সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে। দেখা হতো। কথা হতো। দিন দিন সে ইসলাম রফিকের প্রিয়পাত্র এবং নির্ভরযোগ্য সহযাত্রী হয়ে ওঠে। আমি ২০১০ সালে কবিতায় বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পেলে সে তার সম্পাদিত ” অদ্রি ” লিটল ম্যাগাজিনে আমাকে নিয়ে আশি পৃষ্ঠার এবং একইভাবে ফারুক সিদ্দিকীকে নিয়ে পঁচাশি পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র সহ রয়েল সাইজের প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার ঢাউস সংখ্যা প্রকাশ করে। ততদিনে সেটা ২০১১ সাল। পত্রিকাটির প্রকাশক হিসাবে কাজ করতেন অচিন্ত্য চয়নের জীবনসঙ্গী চয়নিকা সাথী। অচিন্ত্য চয়ন এবং চয়নিকা সাথীর আসল নাম ভিন্ন। এগুলো তাদের লেখক নাম। চয়নের আসল নাম মোজাম্মেল হক মিলু। চয়নিকা সাথীরও একটা আসল বা সার্টিফিকেটে বর্ণিত নাম আছে। চয়ন এবং সাথী তাদের দুজনই দিনদিন আমাদের পারিবারিক আপনজন হয়ে ওঠে। লীনা ওদের খুবই প্রিয় ভাবি। আজও তা অটুট। তাদের দুজনের মাঝে কিছুদিন আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমরা কষ্ট পেয়েছি। তবে তারা দুজনই আজও আমাদের কাছে আপনজন রয়ে গেছে।
অচিন্ত্য চয়নের নামের কারণে আমরা প্রথমে বিভ্রাটে পড়ি। লীনা প্রথমে ওকে “ অচিন্ত্য দাদা” সম্বোধন করেছিল। পরে তার ছদ্মনামের বিষয়টি জেনে যাই আমরা সাথীর কাছ থেকে। উত্তর-আধুনিকতার হিড়িকে তখন “ অনার্য ” শোনাবে এমনতর লেখক নাম নেয়ার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করা তরুণ কবিদের মাঝে। সেই প্রবণতা দ্রুত পুরাঘটিত অতীত হয়ে যায়। অচিন্ত্য চয়নকে আমি, লীনা এবং আমার দুই ছেলেমেয়ে সবাই ভালোবাসি। আমি তো তাকে বড়ো ভাইয়ের অধিকার ও ভালোবাসা নিয়ে অনেক সময় বকাঝকাও করি। সকল অবস্থায় সে আমাকে তার হিতাকাঙ্ক্ষী বড়ো ভাই জ্ঞান করে। এর কোনো ব্যতিক্রম আজ অবধি ঘটেনি। সকল অবস্থায় ওর হাসিমাখা মুখ আমাদের সুখ দেয়। বজলুল করিম বাহার-ইসলাম রফিক-খৈয়াম কাদের-দের বগুড়ায় আমার অন্তরঙ্গ মানুষের অভাব নেই। কিন্তু তারপরও যে-বার বা যখন বগুড়া গিয়ে অচিন্ত্য চয়নকে দেখতে পাইনি, আমাদের আনন্দে খানিকটা ঘাটতি থেকে গেছে।
আমার সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অচিন্ত্য চয়ন সেই তখন থেকেই একজন অক্লান্ত সুহৃদ। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে ফিচার সম্পাদক+ সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছে। এখনও একই ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করছে দৈনিক মানবকণ্ঠ নামক বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে। সে সবসময় এবং সকল অবস্থায় আমার লেখা চেয়ে নিয়ে ছেপেছে। আমার জন্মদিন এলে আমার কবিতার ওপর অন্যদের লেখা অন্তত একটা প্রবন্ধ ছেপেছে। অথবা আমার সাক্ষাৎকার। সে নিজেও কয়েকবার সাক্ষাৎকার নিয়েছে আমার। এবং ছেপেছে বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্যপাতা। তার নেয়া একটা বিশাল আকারের সাক্ষাৎকার ২০১৩ সালের ১৯ এপ্রিল দৈনিক “ভোরের কাগজ” এর সাহিত্যবিভাগের প্রথম পাতায় লিড স্টোরি আকারে ছাপানো হয়েছিল । তার নেয়া আরেকটি সাক্ষাৎকার দৈনিক “ অর্থনীতি প্রতিদিন “এর সাহিত্যবিভাগে প্রথম পাতায় লিড স্টোরির ভঙিমায় ছাপানো হয়েছিল। এমন আরও দু-তিনটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন সময়। অচিন্ত্য চয়ন সাধারণত প্রবন্ধ ধরনের কিছু লেখে না। অথচ সে আমার কবিতা নিয়ে “আমিনুল ইসলামের কবিতা : নানা দৃশ্য ও চিত্রকল্পের উঠোন” শিরোনামে একটি মধ্যম আকৃতির সমৃদ্ধ নিবন্ধ লিখেছিল। সেটি ছাপানো হয়েছিল একটি দৈনিকের সাহিত্যাপাতায়। পড়ে পছন্দ হয়েছিল আমারও। সেটি আমার সংগ্রহে আছে কিন্তু এই মুহূর্তে সেই পত্রিকার নাম মনে পড়ছে না—- বয়সের চাপে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে আসার কারণে।
একেবারে ধান ভানতে শিবের গীত নয়,– অনেকটা বাস্তব কারণে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, অপ্রিয় হলেও সত্য, সকলেই নয়, কিন্তু দু-একজন সাহিত্য সম্পাদক অনেক সময় তাদের ইগোকে জেতাতে চান,—- দু-একজন সাহিত্য সম্পাদক তাদের সাহিত্য বহির্ভূত ব্যক্তিগত সম্পর্ককে জিতিয়ে দিতে চান— সময়ের মোড়ে মোড়ে। দু-একজন সাহিত্য সম্পাদক নিজেদেরকে কবিদের চেয়ে বড়ো কবি মনে করেন। “পদাধিকার বলে” সবকিছু হওয়ার রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা তাদেরকে পেয়ে বসে। মাসখানেক আগে বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি হোয়াটসঅ্যাপে আমার কাছে গভীর মনোবেদনা সহকারে বলেছিলেন, একজন সাহিত্য সম্পাদক তার কবিতা ছাপেন না: ফোন করলে তিনি জানান যে তার কবিতা হয় না, গদ্য বা প্রবন্ধ দিলে ছাপাবেন। ঐ কবির বয়স আমার বয়সের কাছাকাছি। আমি তার কবিতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত। আমি অবাক হয়েছিলাম; কষ্ট পয়েছিলাম তারও বেশি। শোভনীয়তার দাবির কারণে নামগুলো উহ্য রেখে দিয়েছি চিরদিনের জন্য। অচিন্ত্য চয়ন সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে এধরনের উগ্র অহংবোধ থেকে মুক্ত। সে সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে বরাবরই আপসহীন ব্যঞ্জনায় Inclusive mind এর অধিকারী বলে আমি লক্ষ করে এসেছি এবং আসছি— বছরের পর বছর। অমুকের লেখা ছাপবো না, অমুককে দাবিয়ে রাখতে হবে, অমুক তো করতোয়াপন্থী, অমুকের শশুর তো বটগাছ মার্কায় ভোট দেন— — এমনতর অন্ধতা তার ভাবনায় স্থান পায়নি কোনোদিন। সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে অচিন্ত্য চয়ন লেখা ছাপে, লেখককে ছাপে না। অচিন্ত্য চয়নের ব্যক্তিগত আচরণে কোনো ঔদ্ধত্যপনা নেই, — নেই কোনো সবজান্তা হামবড়া ভাব। সে পত্রিকার চাকরিটাকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেনি কোনোদিন। আজও নয়। এককথায় সে সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে লেখকদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চায়নি কোনোদিন। এখনও করে না সেটা। আরেকটি কথা, চান্স পেলেই যারা পুরোনো বন্ধুদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন, নগদ বা সম্ভাব্য লাভ লোকসানের হালখাতা নিয়ে যারা সম্পর্ককে যোগ-বিয়োগ করেন, অচিন্ত্য চয়ন তাদের মতো নন। সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে সে নির্লোভ সাধু-সন্ন্যাসী— একথা বলছি না, তবে সুযোগের পরিবর্তন কিংবা প্রত্যাশিত অজুহাত অথবা অন্য কোনোকিছুই তাকে অকৃতজ্ঞ করে তোলেনি কখনও।
বিশ্ব্যব্যাপী সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে পুঁজিবাদী ধনিকশ্রেণির হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিডিয়াগুলো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক বুলডোজার , পুঁজিবাদী পণ্যসংস্কৃতির বাজার সম্প্রসারণ, আধিপত্যবাদী হেজেমনি ও ফ্যাসিবাদ হাতে নিয়ে তৎপর রাষ্ট্রের মতলববাজি প্রযোজিত মিথ্যা প্রচারণা ইত্যাদির হাতিয়ার হয়ে কাজ করছে। এসময়ের একজন কবির একটি কবিতায় এমন ছবি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কবিতাটির নাম : “ গফুর বলদ পোষে জমিদার পালিছে মিডিয়া”। পাঠকের পড়ার জন্য উদ্ধৃত করে দিচ্ছি এখানে:
“চুরিবিদ্যা বড়বিদ্যা–এটা আজ অতীতের শ্লোক
মলে মলে সিসিটিভি–বর্ডারেও ওয়াচ টাওয়ার
শূন্যে ঝোলে উপগ্রহ–আকাশে পাতালে তার চোখ
কোথায় চুরির রাত? রাতদিন নিউজ আওয়ার!
সাগরে ডাকাতি কত–লুটপাট প্রবাল ঝিনুক
তার চেয়ে মূল্যবান তরল সোনার গোডাউন
লুণ্ঠিত মাটির নিচে সোনাদানা হীরক সিন্দুক
বিবিসি ও সিএনএন হাতে? তবে করে যাও খুন!
স্বাধীনতা, সংগ্রাম, জঙ্গী, খুনী, লড়াই বাঁচার
ইত্যকার শব্দগুলো পেয়ে গেছে নতুন তর্জমা
কী হবে কলেজে গিয়ে? অভিধান? মূল্য কিবা তার!
ক্ষমতার দশমুখ, সে নিয়েছে সব অর্থ জমা।
চোরের জননী কাঁদে–দ্যাখো তার খালি চুলো-হাঁড়ি
কিন্তু যার প্রেস-টিভি, তাকে তুমি ঠেকাবে কী দিয়া?
তাই তো মিডিয়া নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত কাড়াকাড়ি,
গফুর বলদ পোষে, জমিদার পালিছে মিডিয়া।”
[‘গফুর বলদ পোষে, জমিদার পালিছে মিডিয়া’]
দুয়েকটি ব্যতিক্রমী দেশ ছাড়া আজ সারা বিশ্বেই পুঁজিবাদী মালিকের হয়ে কাজ করা সংবাদকর্মীদের কাজের স্বাধীনতাও নিদারুণভাবে সঙ্কুচিত । নানাবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই দুচারজন সংবাদকর্মী সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে কাজ করে যান অনেকটা বিদ্রোহী কবির ” শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল ” কৌশলে। ঝুঁকি তো থাকেই। কাউকে কাউকে জীবনের বিনিময়ে শোধ করে যেতে হয় সেই ঝুঁকির দাম। আর যারা লোভের যাত্রার ধ্বনি শুনে তার নিত্য উধাও রথের যাত্রী হন, তারা নানা রকমের নগদ লাভের মুখ দেখেন। অচিন্ত্য চয়নকেও এমন বৈশ্বিক ভূগোলের এক কোণে বসে কাজ করতে হয়। একজন সংবাদকর্মী হিসাবে তার গায়ে সে-ধরনের দুর্গন্ধ লাগেনি কোনোদিন, এটা ভালো লাগে আমার। উল্লেখ্য, চয়ন একটি পুস্তক প্রকাশনা সংস্থার সাথেও মালিকানা/ পরিচালনা পর্যায়ে জড়িত আনেকদিন যাবৎ।
যে ভুলের ঊর্ধ্বে সে তো মানুষ নয়। অচিন্ত্য চয়ন একজন মানুষ। “To err is human, to forgive is divine”. আমরা সুনির্দিষ্টভাবে না জানলেও অনুমান করে নিতে পারি—আর দশজন মানুষের মতো তার জীবনেও কিছু ভুলত্রুটি আছে। সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন। তার ব্যক্তিজীবনকে আমি তার পেশাগত জীবনে টেনে আনতে চাই না। তার ভাগ বা দায়ভার লেখক বা বন্ধুদের বইতে হয় না। সাহিত্যাঙ্গনে কারও ব্যক্তিগত জীবনের হালখাতা অন্যদের মিলিয়ে দেখার কোনো সৎ যুক্তি নেই যদি না তা দেশের বা জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে প্রভাব-সৃষ্টিকারী ব্যঞ্জনায় ও মাত্রায় স্পর্শ করে। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ কবিদেরকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে খুঁজে না দেখতে পরামর্শ দিয়ে গেছেন:
“ মানুষ-আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে,
ভূমিতে লুটায় প্রতি নিমেষের ভরে,
যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে,
কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে। “
কবিদের বিচারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের হিতোপদেশ অন্যান্য পেশার মানুষের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও কমবেশি প্রযোজ্য হতে পারে। প্রশ্ন: “ বৃক্ষ তোমার নাম কী? “ —উত্তর: “ ফলেই পরিচয়। ”—- এই ফরমুলা অনুসৃত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে একটা কথা, আজকের ইন্টার চালিত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, হ্যাকার, পেগাসাস ইত্যাদি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে সবখানি ব্যক্তিগত থাকছে দিচ্ছে না। ফলে সেলিব্রেটি ধরনের মানুষদের কিছু সাবধানতা ও সংযম অবলম্বন করাই বেহতর।
অনেক দিন হয়, অচিন্ত্য চয়নের সাথে দেখা নেই। অবশ্যই কথা হয়। তবে তা সেলফোনে। আজ বিলম্বিত সকালে ফেসবুক চোখে আলো ফেলে জানিয়ে দিলো ” আজ অচিন্ত্য চয়নের জন্মদিন! তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে না কবি? “
অবশ্যই জানাবো। অতএব শুভ জন্মদিন কবি+সাহিত্য সম্পাদক+প্রকাশক+মানুষ অচিন্ত্য চয়ন।